Tuesday 18 May 2021

টানাপোড়েন ১: কোষে তড়িৎ প্রবাহ

কথায় আছে ' কান টানলে মাথা আসে ', কান টানলে ব্যাথাও হয়, আর কান টানার মূল লক্ষ্য যে সেটা তা বলা বাহুল্য।

লুইজিকে এখন নতুন করে সব ভাবতে হবে, কারণ কানে এসেছে যেটা ভেবেছিলেন সেটা অন্য একজন করে দেখাবে । এর পর লুইজি যেটা করে দেখালেন সেটা যে মেরি শেলীকে "ফ্রাঙ্কেনস্টাইন" লেখাতে উদ্বুগ্ধ করবে আর আলেসান্দ্রো ভোল্টাকে ব্যাটারি তৈরিতে প্ররোচিত করবে সেটা বোধ হয় "মা গঙ্গাও জানতেন না" । লুইজি তাঁর  "Commentary on the effects on electricity and mascular motion" শীর্ষক লেখাতে যা ছেপে বের করলেন তার সারবত্তা এই যে ব্যাঙের পেশিতে তড়িৎ প্রবাহ ঘটালে ব্যাঙের পেশি নড়ে চড়ে ওঠে এবং প্রাণীদের স্নায়ু কাজ করে তড়িৎ প্রবাহের মাধ্যমে এতে আত্মা টাত্মার*১ বালাই নেই । এ গেল অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের লুইজি গ্যালভানি র কথা ।

ছোটবেলায় কেসি (Kacy) যখন প্রথম বৈদ্যুতিক শক খেয়েছিলেন, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ওপর প্রেমটাও বোধ হয় তখন থেকেই দৃঢ় হয়েছিল । শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার যাত্রাপথে যখন আরউইং ল্যাংমুর (Irving Langmuir ), পিটার ডিবাই (Peter Debye), আর জন জাখারি ইয়ং (Jhon Zachary Young) এর সান্নিধ্যে এলেন তখন একরকম ঠিকই করে নিলেন শেষপর্যন্ত যা করবেন তা কেবল পদার্থবিদ্যাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না জীবের কোষপর্দাকেও এর সঙ্গে জুড়বেন। শেষপর্যন্ত যোগ দিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবপদার্থবিদ্যা আর বিকিরণ বিভাগের হেড হিসেবে । প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে বিকিরণ (Radiation) বিভাগের হেড হিসেবে তিনি লিঁও জিলার্ডের সঙ্গে মিলে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের তীব্র বিরোধিতাও করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই পরিণতি হয়তো অবশ্যম্ভাবী ছিল । 

যা হোক, তিরিশের দশকে ব্রিটিশ শরীরবিজ্ঞানী জন জাখারি ইয়ং (Jhon Zachary Young) কম্বোজ শ্রেণীর প্রাণীদের নিয়ে গবেষনা করছিলেন । অক্টপাস, স্কুইড এসব প্রাণীরা কম্বোজ গোত্রে পরে । প্রাণীদেহে তড়িৎপ্রবাহ কিভাবে হয় সেটা নিয়ে গবেষণা করার জন্য উপযুক্ত একটি মাধ্যম আবিষ্কার করলেন - "gient squid axon" বা দানবাকৃতি স্নায়ু কোষ ।এই স্নায়ু কোষের একদিক এতটাই স্থূল যে ওতে সুক্ষ রডের আকৃতির তড়িৎ প্রবাহী ঢুকে যাবে এবং তড়িতের পরিমান আর ধরন মাপা যাবে । সে কাজটি করলেন আমাদের কেসি ওরফে কেনেথ কোলে (Kenneth Cole) আর জর্জ মারমোঁ (George Marmont)। কেনেথ আর জর্জের আবিষ্কার সেই পদ্ধতি হলো ঋণাত্মক তড়িৎ প্রতিক্রিয়া (Negative feedback)। এই ঋণাত্মক তড়িৎ প্রতিক্রিয়াটি করা হয় যে যান্ত্রিক আয়োজনের মাধ্যমে তাকে বলে আধান নিয়ন্ত্রণ বন্ধনী (Voltage Clamping)। মোদ্দা কথাটি হলো, "যে থেকে  তে যে পরিমানে তড়িৎ প্রবাহ হচ্ছে, সেই পরিমান তড়িৎ যদি থেকে তে প্রবাহিত করতে বাধ্য করা হয় তবে কোনো তড়িৎ প্রবাহই আর হবে না । সেই বাধ্য করেই আমাদের মাপতে হবে ঠিক কতটা আধান পার্থক্য জীবকোষপর্দার দুপাশে থাকলে তড়িৎ প্রবাহ আর হয় না । এই না হলে বিজ্ঞানী*২ !

পরে কেনেথ আর জর্জের যান্ত্রিক আয়োজনটির আরো পরিবর্তন করে নিখুঁত ভাবে তড়িৎ প্রবাহ মাপার কাজটি করলেন অ্যালেন হজকিন (Alan Hodgkin) এবং তার পিএইচডি ছাত্র অ্যান্ড্রু হাক্সলে (Andrew Huxley)। কিভাবে করলেন - ব্যাপারটা বাংলায় বোঝা যাক। প্রথমে দুটি তড়িৎদ্বার বানানো হলো, যার একটি দানবাকৃতি স্নায়ু কোষে ঢুকে যাবে অন্য টি বাইরের পরিবেশে থাকবে । প্রথমটিকে মাপক তড়িৎদ্বার (measuring electrode) , দ্বিতীয়টি নির্ণায়ক তড়িৎদ্বার (reference electrode)। চিত্র ১ এ যান্ত্রিক আয়োজনটি দেখানো হয়েছে।

চিত্র ১. আধান নিয়ন্ত্রণ বন্ধনী মাধ্যমে দানবাকৃতি স্নায়ু কোষে তড়িৎপ্রবাহ মাপার ব্যবস্থা ।




















১) যদি দানবাকৃতি স্নায়ু কোষ থেকে কোনো তড়িৎ প্রবাহ হয় তবে তা মাপক তড়িৎদ্বার আর নির্ণায়ক তড়িৎদ্বারের মাধ্যমে জানা যাবে, তারপর তা সংকেত পরিবর্ধক এর মাধ্যমে বেশ কয়েক গুন্ বাড়াতে হবে, কারণ কোষের মধ্যে তড়িতের পরিমান খুব - খুব কম যা  যন্ত্রে সুস্পষ্ট ধরা পড়া মুশকিল । ধরা যাক এই তড়িৎ প্রবাহ Vm  এর সমতুল্য ।

অতএব, কোষের ভেতরের আর বাইরের আধান পার্থক্য = Vm যার জন্য তড়িৎ প্রবাহ হচ্ছে ।

২) এরপর Vm কে শুন্য করার জন্য বাইরে থেকে তড়িৎ পার্থক্য কত দরকার তা যন্ত্র অতি দ্রুত নির্ধারণ করে । ধরা যাক সেটি Vc । সংকেত সম্মন্বয়ীকারক পরিবর্ধক এই Vc এর সমানুপাতিক তড়িৎ প্রবাহ ঘটাবে । 

৩) তড়িৎ পরিমাণ নথিকারকের মাধ্যমে জানা গেল যে কত পরিমান তড়িৎ প্রবাহ হলো ।

৪) সেই পরিমান তড়িৎ কোষে পাঠানো হলো তড়িৎ সরবরাহকারী তড়িৎদ্বার মাধ্যমে, ফলে কোষের থেকে তড়িৎ প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে ।

তড়িৎ পরিমাণ নথিকারকের মাধ্যমে জানা গেল Vc এর পরিমান কত। যে Vc পরিমানে কোষের থেকে আর কোনো তড়িৎ প্রবাহই আর হয় না সেই Vc কে বলা হয় স্থিতাবস্থা আধান পার্থক্য  ।

এই ক্ষণজন্মা তড়িৎপ্রবাহ আর এই যৎসামান্য আধানের পার্থক্যের সাধ্য কি তা পরে বলা যাবে ।

----------------------------------------------------------
*১ সে সময়কার বহু গুণী ব্যক্তি, যেমন দার্শনিক ও গণতজ্ঞ রেঁনে দেকার্তে (Rene Descartes :যার নামে কার্টেসিয়ান কোঅর্ডিনেটস) মনে করতেন যে আমাদের স্নায়বিক প্রবাহ মূলত আত্মার চলন গমনের দ্বারা প্রভাবিত । কেমব্রিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস গিলসন কাঁচের জারে হাতটাত ঢুকিয়ে মুঠো খুলে আর বন্ধ করে একটি পরীক্ষাও করেন, আর সিদ্ধান্তে আসেন যে আত্মার প্রবাহ, মুঠো খুলে আর বন্ধ করার ফলে যে পরিমান জল অপসারিত হয় তার সমানুপাতিক !

[সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এরা সকলেই পদার্থবিজ্ঞানী তাও যত উৎসাহ জীববিজ্ঞানে ]

*২ দুটো কথা আমার এখনো মনে আছে । এ উক্তি আমার স্কুলের শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইদের । "বিজ্ঞানীদের খুব বুদ্ধি " , আর "এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান"।


*পরিভাষা :
ঋণাত্মক তড়িৎ প্রতিক্রিয়া = Negative Feedback 
আধান নিয়ন্ত্রণ বন্ধনী = Voltage Clamping 
মাপক তড়িৎদ্বার = Measuring (অথবা Recording) Electrode 
নির্ণায়ক তড়িৎদ্বারের = Reference Electrode 
সংকেত পরিবর্ধক = Voltage Amplifier (এখানে)
সংকেত সম্মন্বয়ীকারক পরিবর্ধক = Voltage Feedback Amplifier 
তড়িৎ পরিমাণ নথিকারকের = Measure Current 
তড়িৎ সরবরাহকারী তড়িৎদ্বার = Current Supplying Electrode
স্থিতাবস্থা আধান পার্থক্য = Resting Potential 

তথ্য সংগ্রহ : ইন্টারনেট 


















Wednesday 15 July 2020

প্রোথিত দশা ৩

Nadar  চলেছেন সাখ্যাৎকার  নিতে । ১৮৮৬ সাল, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ছবিসহ সাখ্যাৎকার হবে এটা। Nadar এর মুকুটে তখন পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম Aerial ফটোগ্রাফারের শিরোপা *১। এবার জুড়বে প্রথম ছবিসহ সাখ্যাৎকার তোলার শিরোপা । যার সাখ্যাৎকার নিতে চলেছেন তার বয়স একশো পূর্ণ হবে এই আগস্টের শেষে - তিনি বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ রসায়নবিজ্ঞানী  Michel Eugene Chevreul । ফ্রেডরিক রাইনিৎজার কোলেস্টেরোলের "তরলাইত-স্ফটিক"দশার আবিষ্কর্তা (প্রোথিত দশা ১) আর কোলেস্টেরল এর নামকরণ যিনি করেন, তিনি Michel Eugene Chevreul ।

"কোলেস্টেরল" নামটা একটু স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তির কাছে বিভীষিকার মতন । উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগের সঙ্গে নামটা যেমন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, উহান ভাইরাস বা Covid-19 ভাইরাসের সঙ্গেও তার একটা প্রছন্ন যোগাযোগ থাকতে পারে । কিভাবে ? উহান ভাইরাস আমাদের দেহকোষের প্রবেশের জন্য, আমাদের দেহের একটি প্রোটিনকে ব্যবহার করে । আমাদের দেহের ওই দায়ী প্রোটিনটি হলো "এনজিওটেনসিন - ২ (Angiotensin-II)" । আমরা বেশিরভাগ উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করি তাও এনজিওটেনসিন - ২ এর কাজ বন্ধ করে থাকে । দেখা গিয়েছে "স্ট্যাটিন" নামক যে ওষুধটি খেলে আমাদের দেহের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে, সেই "স্ট্যাটিন" ওষুধটি খাওয়া লোকেদের প্রতি উহান ভাইরাস কম আক্রমণাত্মক । যদিও এখনো পর্যন্ত কোলেস্টেরল আর উহান ভাইরাসের যোগাযোগটা পুরোপুরি প্রমাণিত নয় । তবে সাধারণ বুদ্ধি থেকে এটুকু বলা যায় যে যেহেতু কোলেস্টেরোলের উচ্চরক্তচাপ-হৃদরোগের সঙ্গে সম্পর্ক, আর উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করা হয় এনজিওটেনসিন - ২ এর মাধ্যমে তবে উহান ভাইরাস এর সঙ্গেও কোলেস্টেরোলের সম্পর্ক থাকাটা অস্বাভাবিক নয় । চিত্র ১ এ এনজিওটেনসিন - ২ আর তার সংলগ্ন আমাদের কোষপর্দার প্রোটিনটিকে দেখানো হয়েছে। আর লাল রঙের প্রোটিনটি ভাইরাসের একটা প্রোটিনের অংশ  ।
চিত্র ১. এনজিওটেনসিন-২ আর উহান ভাইরাসের অংশ : উহান ভাইরাসের প্রবেশের মাধ্যম হলো আমাদের দেহের "এনজিওটেনসিন -২" । এনজিওটেনসিন - ২ আবার কোষপর্দা সংলগ্ন প্রোটিনটির মাধ্যমে কাজ করে । আমাদের দেহের আর একটি সম্ভাব্য প্রোটিন (নীল) কেও দেখানো হয়েছে যা উহান ভাইরাস কে আটকে দিতে পারে। কিন্তু সাধারণ ভাবে আমাদের দেহে এই প্রোটিনগুলো থাকে না।

উহান ভাইরাসের প্রবেশ আমাদের মুখ্য আলোচ্য নয় ।  আমাদের প্রোথিত দশার নায়ক "কোলেস্টেরল" এ ফিরে  আসি ।

কোষপর্দার গঠনের ভিত্তিপ্রস্থর Singer আর Nicolson এর মতবাদ (প্রোথিত দশা ২) এতটাই  দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে কোষপর্দার গঠন সহজে বোঝাতে গেলে ওটাই পথ । এ বিষয়ে Nicolson এর একটি সাম্প্রতিক লেখাও আছে । কিন্তু উন্নিশশো আশির দশক থেকেই এই ধারণা তে পরিবর্তন হতে শুরু করে । তার কিছু আমরা আলোচনাও করেছি (প্রোথিত দশা  ২) ।

১৯৬৭ সাল, এই পরিবর্তনের সূচনা মূলত যার হাত ধরে তিনি তখন Rockefeller বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত  । একদা পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাওয়া ছাত্রের গবেষণার বিষয়ও একটা ভাইরাস, না উহান ভাইরাস নয়, আফ্রিকার উগান্ডায় প্রথম আবিষ্কার হওয়া Semliki Forest ভাইরাস । Singer আর Nicolson এর মতবাদ অনুযায়ী আমাদের কোষপর্দা একটা লিপিড সমুদ্র আর এই সুষম ভাবে বিন্যস্ত লিপিডের সমুদ্রে, থেকে থেকে গাছের গুঁড়ির মতো ভেসে চলেছে প্রোটিন । এই Semliki Forest ভাইরাসের প্রাণও লিপিড সমুদ্র দিয়ে ঢাকা, আর তাতে ভেসে চলেছে একটিই প্রোটিন । লিপিড সমুদ্র থেকে প্রোটিনকে আলাদা করতে হলে ব্যবহার করতে হয় detergent । এই detergent কতকটা আমাদের Surf Exel, Ariel, বা Tide এর detergent এর মতোই । ভদ্রলোক ততদিনে Rockefeller থেকে চলে এসেছেন Helsinki বিশ্ববিদ্যালয়ে । Semliki Forest ভাইরাসের ওই প্রোটিনটিকে আলাদা করার চেষ্টা করছিলেন । বাধা পেলেন, কেমন বাধা ? এ প্রোটিন সহজে আলাদা হতে চায় না লিপিড সমুদ্র থেকে ! আজব কান্ড !  Singer আর Nicolson এর মত মানতে হলে লিপিড সমুদ্রের যে অংশেই প্রোটিন ভেসে বেড়াক ওকে আলাদা হতেই হবে । কিন্তু Semliki Forest ভাইরাসের ওই প্রোটিনটি যেন আলাদা । এমন সময় একটা বিশাল সুযোগ এলো ।

বিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে আমেরিকা আর ইউরোপের মধ্যে জীববিজ্ঞান নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন লড়াই শুরু হয়ে গেছিলো *২। আমেরিকাকে মাৎ দিতে জার্মানির হাইডেলবার্গ শহরে প্রতিষ্টা হয় ইউরোপিয়ান মলিক্যুলার বায়োলজি ল্যাবরেটরি । আমরা অনেকেই একে EMBL নাম চিনি। EMBL এর  প্রথম অধিকর্তা হিসেবে যোগ দেন John Kendrew । যোগ দেন Helsinki বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকও ।Semliki Forest ভাইরাসের ওই প্রোটিনটি detergent কে ঠিক কাজ করতে দেয় না । গবেষক তাঁর গবেষণার মাধ্যম পাল্টালেন । কাজ শুরু করলেন এক ধরণের প্রাণীজ কোষ নিয়ে । জীববিজ্ঞানের ভাষাতে ওই কোষের নাম হলো MDCK কোষ । আমরা আগে দেখেছি লোহিত কোষের (Red Blood Cell ) কোষপর্দা নিয়ে কাজ করতে । আমরা দেখেছি লাইপোসোমের কৃত্রিম কোষপর্দার ওপরেও কাজ করতে। কিন্তু MDCK কোষ সেটা কি বস্তু? ১৯৫৮ সালে এই কোষ কে আলাদা করতে সমর্থ হন Stewart Madin আর Norman Darby জুনিয়র । ক্রোকার স্পানিয়াল জাতের কুকুরের বৃক্ক (Kidney) থেকে আলাদা করা কোষ । তবে সে যে সে কোষ নয় । এপিথেলিয়াল কোষ । এপিথেলিয়াল কোষ হলো প্রাণীর দেহের উপরিভাগের কোষ । বিশেষ কারণে এমন উপরিভাগের কোষ গুলিকে একটু বিশেষ আকৃতির হতে হয় (চিত্র ২)।
চিত্র ২. এপিথেলিয়াল কোষ: বাইরের দিকটি কে বলে
এপিক্যাল দিক, ভেতরের দিকটি বেসোল্যাটারাল দিক ।
কমলা তীরচিহ্ন একধরণের লিপিডের গতিপথ ইশারা
করছে আর খয়েরি আর এক ধরণের ।
MDCK কোষ কে ব্যবহার করার কারণ হলো Semliki Forest ভাইরাস বৃক্কের কোষ কে আক্রমণ করে আর MDCK বৃক্কের কোষ । কাজ শুরু করার অচিরেই বোঝা গেল - MDCK কোষের দুটো দিক আকৃতিগত ভাবে শুধু আলাদা তা নয়, দুধারের কোষপর্দার প্রোটিন আর লিপিডের পার্থক্যও স্পষ্ট । চিত্র ২ এ রঙিন তীর চিহ্নের মাধ্যমে এই বিভাজন দেখানো হয়েছে । আর আশ্চর্য্য এই যে , এপিক্যাল দিকের কোষপর্দা থেকে detergent দিয়ে প্রোটিন আলাদা করা যায় না । Semliki Forest ভাইরাসের লিপিড পর্দাও একই ধর্ম দেখায় ।

সব বিবেচনা করে গবেষক দেখালেন যে, এপিক্যাল দিকের কোষপর্দায় লিপিড অণুগুলি সুষমভাবে বিন্যস্ত থাকে না , বরং কিছু কিছু জায়গায় যেন লিপিড অণুগুলি গাঢ় ভাবে সন্নিবদ্ধ থাকে, আর ওই গাঢ় জায়গাগুলো অনমনীয় । যেন অশান্ত সমুদ্রে ভাসমান ভেলা। নামকরণ করা হয় লিপিড রাফ্ট  (lipid raft)। আর লিপিড রাফ্টের কালপ্রিট কে ? কোলেস্টেরল আর সঙ্গে দোসর স্ফিঙ্গলিপিড । লিপিড রাফ্ট detergent এ বশীভূত হয় না । তাই লিপিড রাফ্টএ থাকা প্রোটিনগুলো কে detergent আলাদা করতে পারে না । Kai Simons কে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল ব্যাপারটাকে সর্বজনবিদিত করতে । আশির দশকের মাঝামাঝি লিপিড রাফ্টের ধারণা দিলেও Kai এর মতামত Nature পত্রিকা ছাপতে রাজি হতে হতে ১৯৯৭ সাল হয়ে যায় !

John Beresford Leathes ও প্রায় একই জিনিস লক্ষ্য করেছিলেন (প্রোথিত দশা  ২), যে লিপিডের সঙ্গে থাকা কোলেস্টেরোল লিপিডের ধর্ম পাল্টে দেয়, লিপিড আরো গাঢ় সন্নিবদ্ধ হয়ে যায় ।লিপিডের সমুদ্রে লিপিডের চাঞ্চল্য বন্ধ করতে কোলেস্টেরোল অপরিহার্য ।

প্রাণিকোষে যে লিপিড প্রচুর পরিমানে আছে তা ফোসফাটিডিল কোলিন ।ফোসফাটিডিল কোলিনের একটি পোশাকি নাম আছে, "লেসিথিন"। এই লেসিথিন কোলেস্টেরলের সংস্পর্শে এলে এক্কেবারে সটান সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পরে । নড়াচড়া কমিয়ে দেয় । আমরা ফসফোলিপিডের লম্বা ঠ্যাঙের সঙ্গে পরিচিত (প্রোথিত দশা ১)। জলের সংস্পর্শে এলে এরা সার বেধে দাঁড়িয়ে পরে এও জানি (একটি প্রতীকী কোষ পর্দা) । ফসফোলিপিডের লম্বা ঠ্যাঙগুলো বেশিরভাগই  কার্বন -কার্বন সম্পৃক্ত বন্ধনী দিয়ে তৈরী (carbon - carbon single bond) যা কেবল হাইড্রোজেনের সঙ্গে যুক্ত । উচ্চ মাধ্যমিকের জৈব রসায়নের প্রথম দিকের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে যে কেবল হাইড্রোজেন-অলা কার্বন -কার্বন সম্পৃক্ত বন্ধনীতে বন্ধনীগুলি সবচেয়ে চঞ্চল । তাই লিপিডের সমুদ্রে ফসফোলিপিডের লম্বা ঠ্যাঙগুলো চঞ্চল থাকে । এই চঞ্চলতা কোষপর্দা স্থিত কিছু প্রোটিনের সহ্য হয় না তাই তাদের সুবিধার্থে কোলেস্টেরলের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পরে। কোলেস্টেরল, লিপিডের লম্বা -লম্বা ঠ্যাঙগুলোর মাঝে গ্যাঁট হয়ে বসে পরে ওদের নড়ন-চড়ন থামিয়ে দেয় । এর থেকেই লিপিড রাফ্টের জন্ম ।

Kai এর প্রায় একই সময়, ১৯৮৭ সালে,  আরেকটি  স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ*৩ ডেনমার্কের বিজ্ঞানী Oleg Mouritsen লিপিডের এই "নট নড়ন-চড়ন" দশার কথা বর্ণনা করেন  আর নাম দেন "শৃঙ্খলাবদ্ধ লিপিড" (lipid ordered state) । যেহেতু অসমপর্দার মধ্যে মধ্যে কোলেস্টেরল গেঁথে গেঁথে এই নতুন দশার উদ্ভব তাই "প্রোথিত দশা" । কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান কিন্তু তার পরিমান সীমিত হতে হবে । জীবকোষ গতিমান, আর তাই এই জীবকোষপর্দার চঞ্চলতাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়  ।

--- প্রাপ্তিস্বীকার:  পায়েল


[পরে সময় পেলে কোষপর্দার অনেক গপ্পো আরো বলা যাবে ]

----------------------------------------------------------------------------------------------
*১ ১৮৫৮ সালে প্রথম ফানুসে চড়ে প্যারিস মহানগরীর ছবি তোলেন তিনি। Nadar এর ছবির কিছু অংশ এতে পাওয়া যাবে https://www.youtube.com/watch?v=erT2W5sxaFY .

*২ আমরা আমেরিকা-রাশিয়া , আমেরিকা-চীন এর সম্ভাব্য ঠান্ডা লড়াইয়ের কথা খবরের কাগজের থেকে বেশি করে জানি, কিন্তু যে প্রতিযোগিতা বিজ্ঞান কে ঠেলে তুলেছে তার প্রায় সবটাই আমেরিকা-ইউরোপের ঠান্ডা লড়াইএর ফল বলা যায় । লক্ষণীয় যে সব ক্ষেত্রেই মূল দেশটি হলো আমেরিকা !

*৩ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ পাঁচটি ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যাণ্ড (হেলসিঙ্কি), নরওয়ে , আর আইস্ল্যাণ্ড 

Saturday 20 June 2020

পক্ষীবিক্ষন ও বেজায় শব্দবন্ধ


Florida Project এর Moonee র সংলাপ টা মনে পরে গেল। "these are the rooms we are not suppose to go in .... but let's go anyway ..." "this is not the right time .... but let's indulge it !"

পাতিয়ালায় আসা ইস্তক সক্কাল সক্কাল একটা মিষ্টি অসুবিধায় পরা গেল । ভোরের দিকে ছুটির দিনে জবর ঘুম দিচ্ছি এমন সময় টি-টি-টি-টিট্টিটি করে ডেকে উঠলো জানলার বাইরে । ঘরের জানলার পেছনে পুলিশ গ্রাউন্ড গাছ-গাছালিতে ভর্তি, হ্যাঁ ওখান থেকেই । ঘুমের দশটা বাজলো । উঠে পড়তে হলো । সেলিম আলী র বইটা পরে বোঝা গেল বাবা তাঁর বাছা কে হাঁটা শেখাচ্ছে ।বাছা একটু ইতস্ততঃ করছে । একবার এদিক আর একবার ওদিক করছে । কর, চুপচাপ কর, খামোখা "টি-টি-টি-টিট্টিটি" করে ডাকার কি আছে ? হাট্টিমা (Red Wattled Lapwing) । সার্থক নাম, মাঠে কুকুরকেও ঘোরাঘুরি করতে দেয় না, মাঠটা যেন নিজের সম্পত্তি।

আর (মাঝে মাঝে) দিন দোতালা লাগোয়া ছাদে ঘুরে ঘুরে সেপিয়েন্স এর অতুল কীর্তি অনুভব করছিলাম । একদল বাবু গপ্পো জুড়ে দিলো ।প্রাণখোলা গপ্পো, আর কথার এত তোড় যে এখানে ওখানে ছুটে বেড়াতে হয় ।ছজন ছটফটে বাবুর  বক-বক শুনতে শুনতে পড়া মাথায় উঠলো । Babbler কি সাধে বলে ? ছাতারে

অনলাইনে শিশুদের ক্লাস নেওয়াটা বেশ ঝক্কিসাধ্য ব্যাপার ।প্রায় প্রতিদিন এমন চলছে । ঘরের পাশেই বারান্দা । দুপুরে বেশ ছায়া পরে । ঠিক দুজনে এসে বসে পরে । না, আমার ভাষনে তাদের আগ্রহ নেই, কেবল হা করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে থাকে । একজন শিশু তো জিজ্ঞেস ই করে বসলে "ওটা কি স্যার ?" আমি বললাম অনলাইনের গন্ডগোল হবে, ... তা শুনতে পাচ্ছ তো আমার কথা ? .. "হ্যাঁ স্যার"  .... "তবে শুনে যাও "। ও দুজনের জন্য জল ও রেখে দেওয়া ছিল, আসত - জল পেত  - আর মুখ বেকিয়ে কত শব্দ  । বিভিন্ন "মিঠেকড়া" শব্দ । Common Myna ওরফে শালিক ।

পাশের বাগানটায় গেছি। কারিপাতা আনতে, পাশে হুট-পাট শব্দ । আর পরিত্রাহি ডাক - "ক্রি ক্রয়া - ক্রি ক্রয়া - ক্রি ক্রয়া" । বাবা মা চারটে পোনা কে সামলাচ্ছে । কারিপাতা গাছটা থেকে তোর বাড়িটা কত দুরে ! এতে এত চেঁচানোর কি আছে? আমি চলে যাচ্ছি । পরিবারের সদস্যরা বেশি উড়া উড়ি করে না , অলস।  পোনা গুলোকে মাঝে রেখে দৌড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে । ডাকতে ও আলসামো । একটু ডেকেই, চমকে দিয়ে এখন থেমে গেছে । হতভাগা গুলো Gray Partridges বা ধূসর তিতির ।

সাইকেলে ফিরছি, এসে আমার নজর কাড়তেই হলো ? এত ছোট বহর তাও নজর এড়ালো না ! ধাঁই ধাঁই করে যাচ্ছে আর আসছে । বাড়িতে ফুল ফুটলেই আসবে আর সব পরাগরেণু সাফ করে দেবে । কষ্ট করে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো ! Purple Sunbird তো তাই রোদে ভিজিয়ে ছাড়লো ! বেগুনি মৌটুসী ।

সেদিনও ছাদে পায়চারি করছি সঙ্গে Hadfield এর গগন অভিযান । অমনি সময়ে , সরু কাঠির মতন পেছন ঝোলা সবুজ জামা পরে দুটোকে আসতে হলো । চুপচাপ কাজ সারতে লাগলো । বসে আছে, হটাৎ চলে গেল?, না বেঁকে ফিরলো, আবার বেঁকলো আর ফিরলো ।সঙ্গে করে কি ঘণ্টার মাথা নিয়ে এলো কে জানে? এসে বসে মুখ ঠুকতে লাগলো।  ঠুকে ঠুকে ঢিট করছে আর পকাপক পোকা সাবাড় করছে । দেখতে দেখতে সূর্য অস্ত গেল পড়া আর হলো না । বাঁশপাতি, common Bee-eater.

একে ডেভিডের সঙ্গে তুলনা করা চলে। আকারে গোলিয়াৎ ডেভিডের থেকে বড় হলেও ডেভিডের কাছে তার নাকালের অন্ত নেই । এই ডেভিড কে দু ধরণের গোলিয়াৎ এর সঙ্গে লড়তে দেখেছি । একটা ছোট গোলিয়াৎ আর একটা বাবা-গোলিয়াৎ ।ছোট গোলিয়াৎ কে প্রায়ই দেখা যায়। তা হলে কি হবে স্বভাব তো ভালো নয়, নোংরা নিয়ে ধুলোখেলার অভ্যাস ।ছোট গোলিয়াৎ কে এখানে অনেকেরই নাপসন্দ । খয়েরি-সাদা-কালো দাগওয়ালা জামার লোকগুলোর সঙ্গেও ওদের সমস্যা । আর বাবা গোলিয়াৎ খালি রাজকীয় চালে টৈ -টৈ করে বেড়ায় । খুঁজেই চলেছে তো খুঁজেই চলেছে । ডেভিড নিজের সম্পত্তি, জমিজমা সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল । ছোট বা বাবা -গোলিয়াৎ যদি অনুপ্রবেশ করে সেলফিশ জায়েন্টের থেকেও কড়া শাস্তি । ওদের সব ঝামেলা আমাদের ছাদে এসেই করতে হবে । ডেভিড হলো গিয়ে Drongo, ফিঙে। ছোট গোলিয়াৎ আর বাবা গোলিয়াৎ হলো যথাক্রমে house Crow (পাতিয়ালার পাতিকাক) আর black kite (চিল )। খয়েরি-সাদা-কালো দাগওয়ালা জামার লোকগুলো হল Treepie (হাঁড়িচাচা)।

ফাইনম্যান বলেছিলেন পাখিটার নাম জেনে কি হবে শুধু ! তবে নামটা না থাকলে তো অপরকে তো বোঝানো যেত না সহজে।

Thursday 20 February 2020

প্রোথিত দশা ২


Charles Best একবার তাঁর এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে "আমার পিএইচডি থিসিসের কাজটা বোধ হয় অবিস্বরণীয় হয়ে রইলো. .." তা কেবল এজন্য নয় যে তিনি, Frederick Banting আর James Collip এর সঙ্গে মিলে চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রথম ইনসুলিনের প্রথম সফল প্রয়োগ করেন, বরং তাঁর "PhD পেপারটা  John Bersford Leathes এর মতন একজন খুঁটিয়ে পড়েছেন" বলে ।

১৯২০ র দিকে বিজ্ঞানীরা জীবকোষ পর্দার গঠন নিয়ে প্রথম ব্যাখ্যা দেন । তারপর বিভিন্ন পর্যায়ে, সময়ের মধ্যে দিয়ে, বিভিন্ন মতবাদ যুক্ত-বিযুক্ত হয়ে জীবকোষ পর্দার গঠনের যে চিত্রটা আমরা "মিত্র-চৌধুরী-সাঁতরা " বা "স্যান্যাল-চট্টোপাধ্যায়" বইতে পাই সেটা ১৯৭২ এর দিকে Jonathan Singer এবং Garth Nicolson এর দেওয়া । সে মতবাদ অনুযায়ী কোষপর্দা একটা নমনীয় আকৃতি, যার দুধারে লিপিড অণুগুলি সুষমভাবে বিন্যস্ত থাকে, তাতে সাঁতার কেটে বেড়ায় অসংখ্য প্রোটিন। সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর ওই মতবাদ কে অবিশ্বাস করার অবকাশ ছিল না, কারণ এই ধারণা টি Nigel Unwin এবং Richard Henderson এর ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপিতে তোলা ছবির ওপর সুপ্রথিষ্ঠিত ছিল । Singer এবং Nicolson  র মতবাদ মতবাদ অনুযায়ী কোষপর্দা নমনীয় এবং তার গঠন সর্বত্র সমান। 

ওই ধারণায় প্রথম ধাক্কা লাগে একটি অতি সাধারণ পরীক্ষার মাধ্যমে । পরীক্ষাটিতে কোষপর্দার লিপিড সমুদ্রে কিছু বিশেষ লিপিড ছেড়ে দেওয়া হয় যার বিশেষত্ব হলো বাকি লিপিডগুলোর থেকে ওগুলো আলাদা করে চেনা যাবে । লক্ষ করে দেখা গেল, বিশেষ লিপিডগুলো কোষপর্দার কিছু কিছু জায়গায় জটলা বেঁধে থাকে, সেখানে ওদের নড়াচড়াও বেশ কমে যায় । পরীক্ষাটি করেন, Erich Sackmann, আর তাতে "ঘৃতাহুতি" পরে Morris Karnovsky আর Richard Klausner এর যুগ্ম পরীক্ষা থেকে । Morris Karnovsky কোষপর্দার ওই জটলা বাঁধা জায়গাগুলোর একটা নাম রাখেন "lipid microdomain".  পরে Kai Simons এবং Gerrit ven Meer, "lipid microdomain" বিশ্লেষন করে দেখান লিপিডগুলোর ওই বিশেষ দশার জন্য দায়ী পদার্থটি আমাদের প্রোথিত দশার নায়ক "কোলেস্টেরল"।

John Bersford  Leathes তখন ইংল্যান্ডের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কাউন্সিলের হর্তাকর্তা । দু দুটো হাসপাতালের গবেষণাগারের দায়িত্ব তাঁর ওপর। শারীরবিজ্ঞানের প্রশিক্ষিত হলেও চোখের অসুবিধের কারণে প্র্যাকটিস করতে পারেন নি । শুরু করেন গবেষণা, যা মূলতঃ চিকিৎসাশাস্ত্র বা বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় পক্রিয়া বিষয়ক - যেমন "DNA গঠনকারী অণু আমাদের দেহে কি ভাবে তৈরী আর নষ্ট হয়", "ক্ষুদ্রান্তে কিভাবে খাবারের শোষণ হয়" ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরের দিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে রসায়নবিজ্ঞানের প্রয়োগের দিকে আকৃষ্ট হন আর সে গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল স্নেহ পদার্থ (ফ্যাট বডি) । তখন কে জানতো, যে তাঁর পর্যবেক্ষন কোষপর্দার গঠনের এক নতুন ধারণার সূত্রপাত করবে । আর সেটা বুঝে ব্যাখ্যা করতে আরো ষাট বছর লেগে যাবে ।

১৯২৫ সালে  চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি নামকরা পত্রিকা "Lancet" এ "Role of Fats in Vital Phenomena" শীর্ষক তাঁর একটি লেখা বেরোয় ।সে লেখার সারাংশ করলে দাঁড়ায় যে, লিপিড কেবল জলীয় মাধ্যম কে অপছন্দ করে তা নয়, বিভিন্ন ধরণের লিপিডের পরস্পরের মধ্যেও ছুৎমার্গ আছে । যেমন, শুধু ফসফটিডিল কলিন (PC) আর ফসফটিডিল কলিন/কোলেস্টেরোলের (PC-C) মিশ্রনের ধরণ-ধারণ পরস্পরের থেকে আলাদা । PC-C গুটিসুটি মেরে কম জায়গা নেয়, যেখানে একই পরিমান PC ওর থেকে বেশি জায়গা দখল করে থাকে। বলা বাহুল্য PC এই মগজ-ধোলাই এর জন্য দায়ী কোলেস্টেরল। একাএকা থেকে যে lequid-crystal এর মতন কিম্ভুত দশা দেখতে পারে সে সব করতে পারে (প্রোথিত দশা ১)! কিন্তু কেন ?

                                                                                                                                         চলবে। ...

প্রাপ্তিস্বীকার : ইন্টারনেট

Friday 21 June 2019

প্রোথিত দশা ১

পদার্থের দশা পাঁচটি - অতিতরল, কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, এবং প্লাজমা । এই পাঁচটি দশার যে মধ্যমনি - তরল, একমাত্র সেটি ই জীবের পক্ষে অনুকূল। এর অবশ্য একটা কারণও আছে । জীব গতিমান, কিন্তু তার একটা আকার আছে। এদিকে, কঠিন পদার্থের আকার আছে বটে, কিন্তু তা গতিমান নয় । আবার গ্যাসীয় পদার্থ গতিমান, কিন্তু ওর আকারের বালাই নেই । "জলবৎ তরলের" বরং এ দুটোই আছে। তাই জলে জীবের উদ্ভব, জলই জীবের ধাত্রী ।  কিন্তু জীব তো তরল দশায় বাঁচে না ! তবে জীবের দশা কি ?!

অস্ট্রিয়ার চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় | ১৩৪৮ সাল নাগাদ এর প্রতিষ্ঠা করেন রোম সম্রাট চার্লস IV। ১৮৪৮ নাগাদ এই বিশ্ববিদ্যালয় দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি ভাগ অস্ট্রিয়ার আওতায় পরে যার নাম হয় "কার্ল -ফার্নান্দেস -ইউনিভারস্টেট"। অন্য টি চেক রিপাবলিকের সত্ত্বাধীন থাকে । ১৮৮০ র শেষের দিকে এই "কার্ল -ফার্নান্দেস -ইউনিভারস্টেটেরই"  এক উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক রাইনিৎজার (Friedrich Reinitzer) গাজরের নির্যাস নিয়ে কাজ করছিলেন । উদ্দেশ্য ছিল নির্যাসটির সংকেত নির্ণয় করা । ফ্রেডরিকের পড়াশুনা রসায়নশাস্ত্র আবার উদ্ভিজ্জ-রসায়নেও সমান আগ্রহ। আমরা জানি গাজরের কমলা রঙের জন্য যে পদার্থটি দায়ী সেটিকে "বিটা-ক্যারোটিন" (Beta-Carotine) বলে। গাজরে প্রচুর পরিমানে ক্যারোটিন আছে যা আমাদের চোখের জন্য উপকারী । তিনি দেখলেন যে ওই নির্যাসে ক্যারোটিন ছাড়াও আরো একটা বস্তু আছে যেটাকে গরম করতে থাকলে প্রথমে একটি ধুমায়মান অস্বচ্ছ তরলে পরিণত হয়, তারপর আরো গরম করলে সেটি একেবারে স্বচ্ছ একটি তরলে পরিণত হয়। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন যে গরম করতে থাকলে সেটি আলোতে বর্ণচ্ছটা দেখাতে থাকে। আরো পরিষ্কার করে বললে বলা যায়, ধুমায়মান অবস্থায় সেটি আলোর প্রতিফলন (Reflection) ঘটায়, আর পরের অবস্থায় সেটি আলোর প্রতিসরণ (Refraction) ঘটায়।  তিনি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা না করতে পেরে তৎকালীন বিখ্যাত জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী অট্ট ল্যেম্যান (Otto Lehmann) কে চিঠি লেখেন ও পদার্থটি বিশ্লেষণ করার জন্যও পাঠিয়ে দেন।

অট্ট ল্যেম্যান ছিলেন তৎকালীন সেরা স্ফটিক (crystal) বিশ্লেষকদের মধ্যে একজন । তার নিজের তৈরী মাইক্রোস্কোপে তিনি ততদিন এ বেশ কিছু রাসায়নিক যৌগের বহুরূপতা (Polymorphism) নিয়ে কাজ করে ফেলেছিলেন। তাই ফ্রেডরিক রাইনিৎজার এর কাছে অট্ট ল্যেম্যানের থেকে ভালো আর কেউ হতেই পারতো না। অট্ট ল্যেম্যান তখন সবে জার্মানির কার্লসরুহে (Karlsruhe) কাজে যোগ দিয়েছেন। কাজের খুব চাপ। চাপ টা একটু কমল যখন ইনস্টিটিউট এর হেড হিসেবে হাইনরিশ হার্ৎজের জায়গায় যোগ দেন। তারপর উৎসাহ নিয়ে লেগে পড়লেন ফ্রেডরিকের পাঠানো সেই পদার্থটিকে বিশ্লেষণ করতে। অচিরেই তাঁর মাইক্রোস্কোপ-বিশ্লেষণে ধরা পড়লো পদার্থের একটা নতুন দশা  যার নাম উনি দিলেন - "তরলাইত-স্ফটিক" বা Liquid Crystal"। ফ্রেডরিকের সেই আশ্চর্য পদার্থটির নাম কোলেস্টেরল বেঞ্জোয়েট (Cholesterol Benzoate)।

কোলেস্টেরল আমাদের " অসম পর্দা "র  একটি মূল উপাদান। বাকি লিপিড গুলোর সঙ্গে সেও অবস্থান করে। কিন্তু সে লিপিড গোত্রে পড়লেও তার ধর্ম আর আকারটা (চিত্র) আর পাঁচটা লিপিডের (যেমন ফসফাটিডিল ইথানলএমিন )  মতন নয়। তাই ওদের একটা বিশেষ নামে ডাকা হয় - স্টেরল (Sterol)।

চিত্রে একটি ফসফোলিপিড আর একটি কোলেস্টেরলের আণবিক গঠন দেখানো হয়েছে । ধূসর গোলক গুলো কার্বন পরমাণু, লাল গোলক গুলো অক্সিজেন পরমাণু , নীল গোলক টি নাইট্রোজেন পরমাণু, আর হলদে গোলক টি ফসফরাস পরমাণু:
উপরের চিত্র: ফসফাটিডিল ইথানলএমিন  , নিচের চিত্র:কোলেস্টেরল 


প্রাপ্তিস্বীকার : পায়েল
তথ্য সংগ্রহ : Protein Data Bank, ইন্টারনেট


                                                                                                                                   চলবে...

Sunday 6 January 2019

স্নেহের বিভাজন




ড়ের থেকে জীব, জীবের থেকে জড় নয়। তাই তো জীবকে খেতে পড়তে জড়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রথমবার যখন জীব আর জড় ঝগড়া করে আলাদা হলো, তখন একটা দেওয়ালের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এমন একটা দেওয়াল দরকার ছিল যা অভেদ্য আবার অভেদ্যও নয়। মানে আলাদা করলেও জীবের জীবন ধারণের জন্য যা যা দরকার তা ওই দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে সে নিতে পারবে। জীব তাই শুরু থেকেই স্বার্থপর। সব সুবিধা নেবে কিন্তু আবার আলাদাও থাকবে। কি আর করা, কোষ পর্দা তাই অভেদ্য না হয়ে হলো "প্রভেদক ভেদ্য পর্দা" (Semi-permiable membrane)। 

কোষ পর্দা না হয় প্রভেদক হলো, কিন্তু সে কি একা একা জিনিসপত্র এদিক ওদিক করতে পারে? সত্তরের দশকের প্রথম দিকে Roger David Kornberg এরই উত্তর খুঁজছিলেন। তিনি তখন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির Harden M. McConnell এর Ph.D ছাত্র। Roger Kornberg কোষ পর্দার ওই আদান-প্রদানের ব্যাপার টা লাইপোসোমের 
(একটি প্রতীকী কোষ পর্দাওপর পরীক্ষা করছিলেন। ফসফাটিডিল কোলিন দিয়ে তৈরী ওই লাইপোসোম তিনি একটু কায়দা করে বানিয়েছিলেন। লাইপোসোমের প্রধান উপাদান ফসফাটিডিল কোলিনই রাখেন কিন্তু লাইপোসোমের দুদিকের প্রাচীরের একদিকে ফসফাটিডিল কোলিনের সঙ্গে তার এক ভাইকে রাখেন। সেই ভাইটির নাম টেম্পোকোলিন (TEMPOcholine)। এই টেম্পোকোলিনের একটি বেজোড় ইলেট্রন থাকে, তাই টেম্পোকোলিন ভেতরের দিকে আছে না বাইরের দিকে আছে তার ওপর নির্ভর করে ওই বেজোড় ইলেক্ট্রনটি ভিন্নধর্মী হয়। সেই ভিন্ন ধর্ম ধরা যায় ইলেট্রন প্যারাম্যাগনেটিক রেসোনেন্স এর মাধ্যমে। পরীক্ষায় ধরা পরে যে প্রথম প্রথম কেবলমাত্র ভেতরের দিকে থাকলেও টেম্পোকোলিন পরে বাইরের প্রাচীরেও চলে আসে। টেম্পোকোলিনের এই ডিগবাজি কে  FLIPFLOP বলে।

লিপিড বা টেম্পোকোলিনের এই স্বতঃস্ফূর্ত ডিগবাজি খেতে সময় লাগে বটে কিন্তু ব্যাপারটা কোষপর্দার জন্য শুভ নয়। কারণ এরকম চলতে থাকলে কোষপর্দার শরীর একটা সাম্যতার দিকে এগোবে যেটা একেবারেই 
কাম্য নয়। আবার লিপিড যদি নিজেই অসাম্য তৈরি করতে চায়, সেটিও হবার নয়। কারণ লিপিডের দুটো অংশ থাকে, একটি জল ভালোবাসে আর একটি জল থেকে দূরে থাকে। কোষপর্দার মধ্যে দিয়ে লিপিড টানাটানি করতে গেলে এই ভালোবাসাবাসিগুলো কে বিসর্জন দিতে হবে। তাই লিপিডের একার পক্ষে অসমতা তৈরী করা খুব চাপ। Mark Bretscher ব্যাপারটা অনুমান করেছিলেন। তাঁর দূরদৃষ্টি অনুযায়ী কোষপর্দায় কিছু সহায়ক বস্তু থাকে যারা অসাম্য তৈরী করে আর তার জন্য কোষকে গা ঘামিয়ে কাজ করতে হয়। 

যে প্রোটিনগুলো কোষপর্দায় অসাম্য আনার জন্য বাসা বাঁধে তারা সাধারণতঃ তিন রকমের হয়। একরকম, যারা ভেতর থেকে লিপিড অনু কে বাইরে আনে (উল্টে দেওয়া) একে FLIPPase বলে | চিত্র ১ এ যে উল্টো "Y" আকৃতির প্রোটিনটি দেখানো হয়েছে সেটি একটি FLIPPase। এগুলোর কাজ করার জন্য যে শক্তির দরকার হয় সেটা "এটিপি" সরবরাহ করে। তাই এরকম প্রোটিনগুলো কে ATPase ও বলে।

দ্বিতীয় রকম উলটো কাজটি করে, মানে লিপিড অনুকে বাইরে থেকে ভেতরে আনে (পাল্টে দেওয়া) একে FLOPPase বলে। চিত্র ২ এ যে "কাঁচির" মতন (বন্ধ ও খোলা অবস্থায়) প্রোটিনটিকে দেখানো হয়েছে সেটি FLOPPase। FLOPPase গুলোর কাজের জন্যও এটিপি দরকার হয় তবে এদেরকে "এটিপি-নির্ভর-পরিবনকারী" প্রোটিনও বলে বা ATP-Binding-Cassette (ABC) Transporter বলে।

আর শেষের টি লিপিড অনুকে দুদিকেই ছড়িয়ে দেয় (এলোমেলো করে দেওয়া) একে Scramblase বলে। চিত্র ৩ এ যে "প্রজাপতির পাখনা"র মতন প্রোটিনটি দেখানো হয়েছে সেটি Scramblase। Scramblase গুলোর কাজের জন্য এটিপি-র দরকার হয় না কিন্তু ক্যালসিয়াম এতে সাহায্য করে।


চিত্র ১, ২, ৩: কোষপর্দায় অবস্থানকারী প্রোটিন কর্মকর্তা যারা লিপিড এদিক এদিক ওদিক করে। দুটি ভিন্ন রঙের মাধ্যমে দুটি আলাদা প্রোটিনকে বোঝানো হয়েছে। ১) এটিপি-FLIPPase এটিপি খরচ করে ভেতরের লিপিড বাইরে নিয়ে আসে। এখানে সবুজ আর বেগুনি দুটি আলাদা প্রোটিন। বেগুনি প্রোটিনটি ATPase আর সবুজ টি একটি সহকারী প্রোটিন। ২) এটিপি-নির্ভর-পরিবহনকারী প্রোটিন (ATP Binding Cassette transporter), এটিপি খরচ করে বাইরের থেকে ভেতরে লিপিড নিয়ে আসে। এখানে সবুজ আর বেগুনি দুটি একই প্রোটিন। দুটো প্রোটিন এখানে একসঙ্গে কাজ করে। ৩) লিপিড এলোমেলো করে দেওয়া প্রোটিনটি বা Scramblase ক্যালসিয়ামের সাহায্যে দুপাশেই লিপিড কে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পরিবহন করে।   

প্রাপ্তিস্বীকার : পায়েল
তথ্য সংগ্রহ : Protein Data Bank, ইন্টারনেট


                                                                                                                 চলবে, কিন্তু দেরি হতে পারে !! ...

Friday 28 September 2018

একটি প্রতীকী কোষ পর্দা


যে কোনো একটি কোষকে নিয়ে, তার কোষ পর্দার ওপর কাজ করা অত্যন্ত কঠিন কারণ, কোষের মধ্যে কোষ পর্দা ছাড়াও আলাদা আলাদা অংশ থাকে (যেমন, "মাইটোকন্ড্রিয়া", এন্ডোপ্লাজমিক  রেটিকুলাম", "গলগি বস্তু" ইত্যাদি)। এগুলো, একক ভাবে কোষ পর্দার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার পথে বাধার সৃষ্টি করে। তাই কোষ পর্দার ওপর কাজ করতে এমন একটি কোষের দরকার যে কোষে, কোষ পর্দা ছাড়া বাকি অংশগুলো কম আছে। বৈচিত্রের এই পৃথিবীতে এমন কোষ অমিল নয়।

রক্ত কণিকার জন্ম অস্থিমজ্জা থেকে, অবশ্য সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত যে রক্ত কণিকার জন্ম ফুঁসফুঁসেও হয়। সে যাক গে, লোহিত রক্ত কণিকার বাবা-মা রা অস্থিমজ্জাতেই থাকে। একটি পরিণত লোহিত কণিকা আমাদের জন্য অনেক ত্যাগস্বীকার করে। ওরা জন্মাবার সময় ওদের কোষের ভেতরে একটি অপরিহার্য অংশ "নিউক্লিয়াস" থাকে; কিন্তু যতই বড় হয় ততোই দায়িত্বজ্ঞান বাড়ে এবং আরো বেশি করে অক্সিজেন বহন করার জন্য ওরা ওদের  নিউক্লিয়াসটি পরিত্যাগ করে|  ক্রমে ক্রমে কোষের বাকি অংশগুলোও ("মাইটোকন্ড্রিয়া", এন্ডোপ্লাজমিক  রেটিকুলাম", "গলগি বস্তু") পরিত্যাগ করে । শেষমেশ লোহিত কোষে যে অংশটি থেকে যায় তা প্রধানতঃ তার কোষ পর্দা।  তাই একক ভাবে কোষ পর্দার ওপর কাজ করতে লোহিত কোষের জুড়ি মেলা ভার। এঅবস্থায় লোহিত কোষের পর্দার বাইরের অংশ নিয়ে পরীক্ষা করা যায়। আবার এই লোহিত কোষ কে তার কোষের থেকে কম ঘনত্বের তরলে ফেললে কোষটি তার কাঠামো হারায়। এই প্রক্রিয়া কে হিমোলাইসিস বলে। হিমোলাইসিসের ফলে যেটি পাওয়া যায় সেটিকে বিজ্ঞানীরা লোহিত কোষের ভূত, "Ghost" বলে থাকেন। হিমোলাইসিসের ফলে ওর ভেতরের পর্দার ওপরেও কাজ করা যায়।

কিন্তু রক্ত তো গাছে ফলে না। তাই বিজ্ঞানীরা লোহিত কোষের বিকল্প খুঁজতে লেগে গেলেন, পেলেনও। 

সেই ১৯৬৪ সাল - ঠিক যে বছর Humberto তাঁর আর্টিকেল টি প্রকাশ করেন। সেই বছরই Alec Banghamও ফসফোলিপিডের ওপর একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন জার্নাল অফ মলিক্যুলার বায়োলজিতে। ফসফোলিপিড কি ? আমরা আপাততঃ জেনে রাখি যে ফসফোলিপিড হলো সেই সব lipid যাদের মধ্যে ফসফেট থাকে। আমি গত পর্বে যে চারটে lipid এর কথা লিখেছিলাম তার মধ্যে তিনটির নামের মধ্যে তো "ফসফো" শব্দটি আছেই, এছাড়া স্ফিঙ্গলিপিডের মধ্যেও "ফসফো" অর্থাৎ "ফসফেট" থাকতে পারে। ফসফোলিপিডের মাথা অংশটি জলকে ভালোবাসে, আর পা অংশটি জল থেকে দূরেই থাকে।  

এটা ১৯৫৮-৫৯ এর কথা। Alec Bangham কেম্ব্রিজ থেকে কিছুটা দূরে বব্রাহাম নামের একটা গ্রামে Animal Physiology ইনস্টিটিউটে গবেষণার কাজ করছিলেন। তাঁর গবেষণার পেছনে ছিল ফসফোলিপিড কে জলে ফেললে কিরকম হয় তা জানার ইচ্ছে। Lipid কে জলে মেশালে মিশ্রণটা দুগ্ধবৎ ঘোলা হয়ে যায়। তাই তিনি তাকে Emulsion* আখ্যা দেন। এর পর ১৯৬১ তে বব্রাহামের Institute এ একটা ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ কেনা হয়। Alec খুব উচ্ছসিত। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে ওই দুগ্ধবৎ মিশ্রণটিকে কেমন দেখতে লাগে তা জানার জন্য। Alec এর এক সহকর্মী R. W. Horne তাঁকে এব্যাপারে সাহায্য করেন। কিন্তু দেখার পর বোঝা গেল জিনিসটা Emulsion এর থেকে বেশ আলাদা। 

Alec এর বর্ণনা অনুসারে ফসফোলিপিডগুলো জলে সার বেঁধে বিভিন্ন আকৃতির বদ্ধ খুপরি তৈরী করে। বদ্ধ খুপড়িগুলোর প্রাচীর একস্তরীয় (ইউনি-ল্যামেলার; Uni-lamellar) বা বহুস্তরীয় (মাল্টি-ল্যামেলার; multi-lamellar) হতে পারে। এরকম প্রতিটি স্তরের দুটি দিক থাকে (চিত্র ১.)। একটি দিকের ফসফোলিপিডগুলো অন্য দিকের  ফসফোলিপিডগুলোর পা ধরাধরি করে মাথাগুলো জলীয় মাধ্যমের দিকে উঁচিয়ে রাখে। এভাবে ছোট ছোট জলীয়-মাধ্যম ওয়ালা খুপরি তৈরী হয়, যেখান ভেতরের জলীয় মাধ্যম বাইরের জলীয় মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন ফসফোলিপিডের দ্বারা। ঠিক যেন একটা একটা কোষ পর্দার মতন। Alec ওই খুপড়িগুলোর নাম দেন লাইপোসোম (liposome; গ্রিক lipo = ফ্যাট, soma = শরীর) আর সতীর্থরা মজা করে বলতো "ব্যানঘাসোম" (Banghasomes) 
ক                                    খ    
চিত্র ১.  লাইপোসোম কে একটি ফাঁপা গোলাকৃতি বলয় (ত্রিমাত্রিক) হিসেবে কল্পনা করা চলে যার ভেতরের আর বাইরের দিকে থাকে জলীয় মাধ্যম। চিত্রে লাইপোসোমের দ্বিমাত্রিক গঠন দেখানো হয়েছে। ক) একটি বহুস্তরীয় লাইপোসোম, খ) একটি একস্তরীয় লাইপোসোম, লাইপোসোমের প্রাচীর দুদিকের ফসফোলিপিডগুলো সার বেঁধে - পরস্পরের পা (কালো) ধরে জলের দিকে মাথা (খয়েরি রং) উঁচিয়ে বিরাজ করে (একটি অংশ কে বড় করে দেখানো হয়েছে)।    

লাইপোসোমের আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি বড় অগ্রগতি। লাইপোসোমের মাধ্যমে ওষুধকে শরীরের কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছে দেওয়া যায়। যেমন, এন্থ্রাসাইক্লিন (Anthracycline) ড্রাগগুলি ক্যান্সার কোষের বিভাজন বন্ধ করে। কিন্তু সেই ড্রাগ অন্য কোষে ঢুকলে সে কোষের ক্ষতি। তাই এমন ভাবে কিছু লাইপোসোম বানানো হয় যা কেবল মাত্র ক্যান্সার কোষের সঙ্গেই মিলতে পারে। এভাবে লাইপোসোমের সাহায্যে কেবল ক্যান্সার কোষ কে ধরে ধরে মেরে ফেলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা যে লাইপোসোমকে একটি কৃত্রিম কোষ পর্দা হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে যেখানে শুধু lipid দিয়ে তৈরী কোষ পর্দাই থাকে কিন্তু কোষের বাকি অংশ যেমন প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি থাকে না।

লাইপোসোম আবিষ্কারের খ্যাতি কিন্তু Alec Bangham কে বিচলিত করতে পারে নি। তিনি তাঁর ওই গ্রাম্য ইন্সটিটিউটটির ছোট ল্যাবরেটরিটি ছেড়ে কোথাও যান নি।  

------------------------------------------------------------------------------------------------

* Emulsion হলো গিয়ে দুটো ঠ্যাঁটা অথচ অ-মিশুকে তরলের মিশ্রণ। ঠ্যাঁটা, কারণ একটা আরেকটার থেকে কখনই আলাদা হয় না আবার মিশেও যায় না।


চলবে ...

অনুপ্রেরণা : An Introduction to Biological Membranes: Composition, Structure and Function by William Stillwell

তথ্য সংগ্রহ : ইন্টারনেট

প্রাপ্তিস্বীকার : পায়েল