Friday 21 June 2019

প্রোথিত দশা ১

পদার্থের দশা পাঁচটি - অতিতরল, কঠিন, তরল, গ্যাসীয়, এবং প্লাজমা । এই পাঁচটি দশার যে মধ্যমনি - তরল, একমাত্র সেটি ই জীবের পক্ষে অনুকূল। এর অবশ্য একটা কারণও আছে । জীব গতিমান, কিন্তু তার একটা আকার আছে। এদিকে, কঠিন পদার্থের আকার আছে বটে, কিন্তু তা গতিমান নয় । আবার গ্যাসীয় পদার্থ গতিমান, কিন্তু ওর আকারের বালাই নেই । "জলবৎ তরলের" বরং এ দুটোই আছে। তাই জলে জীবের উদ্ভব, জলই জীবের ধাত্রী ।  কিন্তু জীব তো তরল দশায় বাঁচে না ! তবে জীবের দশা কি ?!

অস্ট্রিয়ার চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় | ১৩৪৮ সাল নাগাদ এর প্রতিষ্ঠা করেন রোম সম্রাট চার্লস IV। ১৮৪৮ নাগাদ এই বিশ্ববিদ্যালয় দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি ভাগ অস্ট্রিয়ার আওতায় পরে যার নাম হয় "কার্ল -ফার্নান্দেস -ইউনিভারস্টেট"। অন্য টি চেক রিপাবলিকের সত্ত্বাধীন থাকে । ১৮৮০ র শেষের দিকে এই "কার্ল -ফার্নান্দেস -ইউনিভারস্টেটেরই"  এক উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক রাইনিৎজার (Friedrich Reinitzer) গাজরের নির্যাস নিয়ে কাজ করছিলেন । উদ্দেশ্য ছিল নির্যাসটির সংকেত নির্ণয় করা । ফ্রেডরিকের পড়াশুনা রসায়নশাস্ত্র আবার উদ্ভিজ্জ-রসায়নেও সমান আগ্রহ। আমরা জানি গাজরের কমলা রঙের জন্য যে পদার্থটি দায়ী সেটিকে "বিটা-ক্যারোটিন" (Beta-Carotine) বলে। গাজরে প্রচুর পরিমানে ক্যারোটিন আছে যা আমাদের চোখের জন্য উপকারী । তিনি দেখলেন যে ওই নির্যাসে ক্যারোটিন ছাড়াও আরো একটা বস্তু আছে যেটাকে গরম করতে থাকলে প্রথমে একটি ধুমায়মান অস্বচ্ছ তরলে পরিণত হয়, তারপর আরো গরম করলে সেটি একেবারে স্বচ্ছ একটি তরলে পরিণত হয়। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন যে গরম করতে থাকলে সেটি আলোতে বর্ণচ্ছটা দেখাতে থাকে। আরো পরিষ্কার করে বললে বলা যায়, ধুমায়মান অবস্থায় সেটি আলোর প্রতিফলন (Reflection) ঘটায়, আর পরের অবস্থায় সেটি আলোর প্রতিসরণ (Refraction) ঘটায়।  তিনি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা না করতে পেরে তৎকালীন বিখ্যাত জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী অট্ট ল্যেম্যান (Otto Lehmann) কে চিঠি লেখেন ও পদার্থটি বিশ্লেষণ করার জন্যও পাঠিয়ে দেন।

অট্ট ল্যেম্যান ছিলেন তৎকালীন সেরা স্ফটিক (crystal) বিশ্লেষকদের মধ্যে একজন । তার নিজের তৈরী মাইক্রোস্কোপে তিনি ততদিন এ বেশ কিছু রাসায়নিক যৌগের বহুরূপতা (Polymorphism) নিয়ে কাজ করে ফেলেছিলেন। তাই ফ্রেডরিক রাইনিৎজার এর কাছে অট্ট ল্যেম্যানের থেকে ভালো আর কেউ হতেই পারতো না। অট্ট ল্যেম্যান তখন সবে জার্মানির কার্লসরুহে (Karlsruhe) কাজে যোগ দিয়েছেন। কাজের খুব চাপ। চাপ টা একটু কমল যখন ইনস্টিটিউট এর হেড হিসেবে হাইনরিশ হার্ৎজের জায়গায় যোগ দেন। তারপর উৎসাহ নিয়ে লেগে পড়লেন ফ্রেডরিকের পাঠানো সেই পদার্থটিকে বিশ্লেষণ করতে। অচিরেই তাঁর মাইক্রোস্কোপ-বিশ্লেষণে ধরা পড়লো পদার্থের একটা নতুন দশা  যার নাম উনি দিলেন - "তরলাইত-স্ফটিক" বা Liquid Crystal"। ফ্রেডরিকের সেই আশ্চর্য পদার্থটির নাম কোলেস্টেরল বেঞ্জোয়েট (Cholesterol Benzoate)।

কোলেস্টেরল আমাদের " অসম পর্দা "র  একটি মূল উপাদান। বাকি লিপিড গুলোর সঙ্গে সেও অবস্থান করে। কিন্তু সে লিপিড গোত্রে পড়লেও তার ধর্ম আর আকারটা (চিত্র) আর পাঁচটা লিপিডের (যেমন ফসফাটিডিল ইথানলএমিন )  মতন নয়। তাই ওদের একটা বিশেষ নামে ডাকা হয় - স্টেরল (Sterol)।

চিত্রে একটি ফসফোলিপিড আর একটি কোলেস্টেরলের আণবিক গঠন দেখানো হয়েছে । ধূসর গোলক গুলো কার্বন পরমাণু, লাল গোলক গুলো অক্সিজেন পরমাণু , নীল গোলক টি নাইট্রোজেন পরমাণু, আর হলদে গোলক টি ফসফরাস পরমাণু:
উপরের চিত্র: ফসফাটিডিল ইথানলএমিন  , নিচের চিত্র:কোলেস্টেরল 


প্রাপ্তিস্বীকার : পায়েল
তথ্য সংগ্রহ : Protein Data Bank, ইন্টারনেট


                                                                                                                                   চলবে...

Sunday 6 January 2019

স্নেহের বিভাজন




ড়ের থেকে জীব, জীবের থেকে জড় নয়। তাই তো জীবকে খেতে পড়তে জড়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রথমবার যখন জীব আর জড় ঝগড়া করে আলাদা হলো, তখন একটা দেওয়ালের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এমন একটা দেওয়াল দরকার ছিল যা অভেদ্য আবার অভেদ্যও নয়। মানে আলাদা করলেও জীবের জীবন ধারণের জন্য যা যা দরকার তা ওই দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে সে নিতে পারবে। জীব তাই শুরু থেকেই স্বার্থপর। সব সুবিধা নেবে কিন্তু আবার আলাদাও থাকবে। কি আর করা, কোষ পর্দা তাই অভেদ্য না হয়ে হলো "প্রভেদক ভেদ্য পর্দা" (Semi-permiable membrane)। 

কোষ পর্দা না হয় প্রভেদক হলো, কিন্তু সে কি একা একা জিনিসপত্র এদিক ওদিক করতে পারে? সত্তরের দশকের প্রথম দিকে Roger David Kornberg এরই উত্তর খুঁজছিলেন। তিনি তখন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির Harden M. McConnell এর Ph.D ছাত্র। Roger Kornberg কোষ পর্দার ওই আদান-প্রদানের ব্যাপার টা লাইপোসোমের 
(একটি প্রতীকী কোষ পর্দাওপর পরীক্ষা করছিলেন। ফসফাটিডিল কোলিন দিয়ে তৈরী ওই লাইপোসোম তিনি একটু কায়দা করে বানিয়েছিলেন। লাইপোসোমের প্রধান উপাদান ফসফাটিডিল কোলিনই রাখেন কিন্তু লাইপোসোমের দুদিকের প্রাচীরের একদিকে ফসফাটিডিল কোলিনের সঙ্গে তার এক ভাইকে রাখেন। সেই ভাইটির নাম টেম্পোকোলিন (TEMPOcholine)। এই টেম্পোকোলিনের একটি বেজোড় ইলেট্রন থাকে, তাই টেম্পোকোলিন ভেতরের দিকে আছে না বাইরের দিকে আছে তার ওপর নির্ভর করে ওই বেজোড় ইলেক্ট্রনটি ভিন্নধর্মী হয়। সেই ভিন্ন ধর্ম ধরা যায় ইলেট্রন প্যারাম্যাগনেটিক রেসোনেন্স এর মাধ্যমে। পরীক্ষায় ধরা পরে যে প্রথম প্রথম কেবলমাত্র ভেতরের দিকে থাকলেও টেম্পোকোলিন পরে বাইরের প্রাচীরেও চলে আসে। টেম্পোকোলিনের এই ডিগবাজি কে  FLIPFLOP বলে।

লিপিড বা টেম্পোকোলিনের এই স্বতঃস্ফূর্ত ডিগবাজি খেতে সময় লাগে বটে কিন্তু ব্যাপারটা কোষপর্দার জন্য শুভ নয়। কারণ এরকম চলতে থাকলে কোষপর্দার শরীর একটা সাম্যতার দিকে এগোবে যেটা একেবারেই 
কাম্য নয়। আবার লিপিড যদি নিজেই অসাম্য তৈরি করতে চায়, সেটিও হবার নয়। কারণ লিপিডের দুটো অংশ থাকে, একটি জল ভালোবাসে আর একটি জল থেকে দূরে থাকে। কোষপর্দার মধ্যে দিয়ে লিপিড টানাটানি করতে গেলে এই ভালোবাসাবাসিগুলো কে বিসর্জন দিতে হবে। তাই লিপিডের একার পক্ষে অসমতা তৈরী করা খুব চাপ। Mark Bretscher ব্যাপারটা অনুমান করেছিলেন। তাঁর দূরদৃষ্টি অনুযায়ী কোষপর্দায় কিছু সহায়ক বস্তু থাকে যারা অসাম্য তৈরী করে আর তার জন্য কোষকে গা ঘামিয়ে কাজ করতে হয়। 

যে প্রোটিনগুলো কোষপর্দায় অসাম্য আনার জন্য বাসা বাঁধে তারা সাধারণতঃ তিন রকমের হয়। একরকম, যারা ভেতর থেকে লিপিড অনু কে বাইরে আনে (উল্টে দেওয়া) একে FLIPPase বলে | চিত্র ১ এ যে উল্টো "Y" আকৃতির প্রোটিনটি দেখানো হয়েছে সেটি একটি FLIPPase। এগুলোর কাজ করার জন্য যে শক্তির দরকার হয় সেটা "এটিপি" সরবরাহ করে। তাই এরকম প্রোটিনগুলো কে ATPase ও বলে।

দ্বিতীয় রকম উলটো কাজটি করে, মানে লিপিড অনুকে বাইরে থেকে ভেতরে আনে (পাল্টে দেওয়া) একে FLOPPase বলে। চিত্র ২ এ যে "কাঁচির" মতন (বন্ধ ও খোলা অবস্থায়) প্রোটিনটিকে দেখানো হয়েছে সেটি FLOPPase। FLOPPase গুলোর কাজের জন্যও এটিপি দরকার হয় তবে এদেরকে "এটিপি-নির্ভর-পরিবনকারী" প্রোটিনও বলে বা ATP-Binding-Cassette (ABC) Transporter বলে।

আর শেষের টি লিপিড অনুকে দুদিকেই ছড়িয়ে দেয় (এলোমেলো করে দেওয়া) একে Scramblase বলে। চিত্র ৩ এ যে "প্রজাপতির পাখনা"র মতন প্রোটিনটি দেখানো হয়েছে সেটি Scramblase। Scramblase গুলোর কাজের জন্য এটিপি-র দরকার হয় না কিন্তু ক্যালসিয়াম এতে সাহায্য করে।


চিত্র ১, ২, ৩: কোষপর্দায় অবস্থানকারী প্রোটিন কর্মকর্তা যারা লিপিড এদিক এদিক ওদিক করে। দুটি ভিন্ন রঙের মাধ্যমে দুটি আলাদা প্রোটিনকে বোঝানো হয়েছে। ১) এটিপি-FLIPPase এটিপি খরচ করে ভেতরের লিপিড বাইরে নিয়ে আসে। এখানে সবুজ আর বেগুনি দুটি আলাদা প্রোটিন। বেগুনি প্রোটিনটি ATPase আর সবুজ টি একটি সহকারী প্রোটিন। ২) এটিপি-নির্ভর-পরিবহনকারী প্রোটিন (ATP Binding Cassette transporter), এটিপি খরচ করে বাইরের থেকে ভেতরে লিপিড নিয়ে আসে। এখানে সবুজ আর বেগুনি দুটি একই প্রোটিন। দুটো প্রোটিন এখানে একসঙ্গে কাজ করে। ৩) লিপিড এলোমেলো করে দেওয়া প্রোটিনটি বা Scramblase ক্যালসিয়ামের সাহায্যে দুপাশেই লিপিড কে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পরিবহন করে।   

প্রাপ্তিস্বীকার : পায়েল
তথ্য সংগ্রহ : Protein Data Bank, ইন্টারনেট


                                                                                                                 চলবে, কিন্তু দেরি হতে পারে !! ...