কথায় আছে ' কান টানলে মাথা আসে ', কান টানলে ব্যাথাও হয়, আর কান টানার মূল লক্ষ্য যে সেটা তা বলা বাহুল্য।
লুইজিকে এখন নতুন করে সব ভাবতে হবে, কারণ কানে এসেছে যেটা ভেবেছিলেন সেটা অন্য একজন করে দেখাবে । এর পর লুইজি যেটা করে দেখালেন সেটা যে মেরি শেলীকে "ফ্রাঙ্কেনস্টাইন" লেখাতে উদ্বুগ্ধ করবে আর আলেসান্দ্রো ভোল্টাকে ব্যাটারি তৈরিতে প্ররোচিত করবে সেটা বোধ হয় "মা গঙ্গাও জানতেন না" । লুইজি তাঁর "Commentary on the effects on electricity and mascular motion" শীর্ষক লেখাতে যা ছেপে বের করলেন তার সারবত্তা এই যে ব্যাঙের পেশিতে তড়িৎ প্রবাহ ঘটালে ব্যাঙের পেশি নড়ে চড়ে ওঠে এবং প্রাণীদের স্নায়ু কাজ করে তড়িৎ প্রবাহের মাধ্যমে এতে আত্মা টাত্মার*১ বালাই নেই । এ গেল অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের লুইজি গ্যালভানি র কথা ।
ছোটবেলায় কেসি (Kacy) যখন প্রথম বৈদ্যুতিক শক খেয়েছিলেন, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ওপর প্রেমটাও বোধ হয় তখন থেকেই দৃঢ় হয়েছিল । শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার যাত্রাপথে যখন আরউইং ল্যাংমুর (Irving Langmuir ), পিটার ডিবাই (Peter Debye), আর জন জাখারি ইয়ং (Jhon Zachary Young) এর সান্নিধ্যে এলেন তখন একরকম ঠিকই করে নিলেন শেষপর্যন্ত যা করবেন তা কেবল পদার্থবিদ্যাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না জীবের কোষপর্দাকেও এর সঙ্গে জুড়বেন। শেষপর্যন্ত যোগ দিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবপদার্থবিদ্যা আর বিকিরণ বিভাগের হেড হিসেবে । প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে বিকিরণ (Radiation) বিভাগের হেড হিসেবে তিনি লিঁও জিলার্ডের সঙ্গে মিলে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের তীব্র বিরোধিতাও করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই পরিণতি হয়তো অবশ্যম্ভাবী ছিল ।
যা হোক, তিরিশের দশকে ব্রিটিশ শরীরবিজ্ঞানী জন জাখারি ইয়ং (Jhon Zachary Young) কম্বোজ শ্রেণীর প্রাণীদের নিয়ে গবেষনা করছিলেন । অক্টপাস, স্কুইড এসব প্রাণীরা কম্বোজ গোত্রে পরে । প্রাণীদেহে তড়িৎপ্রবাহ কিভাবে হয় সেটা নিয়ে গবেষণা করার জন্য উপযুক্ত একটি মাধ্যম আবিষ্কার করলেন - "gient squid axon" বা দানবাকৃতি স্নায়ু কোষ ।এই স্নায়ু কোষের একদিক এতটাই স্থূল যে ওতে সুক্ষ রডের আকৃতির তড়িৎ প্রবাহী ঢুকে যাবে এবং তড়িতের পরিমান আর ধরন মাপা যাবে । সে কাজটি করলেন আমাদের কেসি ওরফে কেনেথ কোলে (Kenneth Cole) আর জর্জ মারমোঁ (George Marmont)। কেনেথ আর জর্জের আবিষ্কার সেই পদ্ধতি হলো ঋণাত্মক তড়িৎ প্রতিক্রিয়া (Negative feedback)। এই ঋণাত্মক তড়িৎ প্রতিক্রিয়াটি করা হয় যে যান্ত্রিক আয়োজনের মাধ্যমে তাকে বলে আধান নিয়ন্ত্রণ বন্ধনী (Voltage Clamping)। মোদ্দা কথাটি হলো, "যে ক থেকে খ তে যে পরিমানে তড়িৎ প্রবাহ হচ্ছে, সেই পরিমান তড়িৎ যদি খ থেকে ক তে প্রবাহিত করতে বাধ্য করা হয় তবে কোনো তড়িৎ প্রবাহই আর হবে না । সেই বাধ্য করেই আমাদের মাপতে হবে ঠিক কতটা আধান পার্থক্য জীবকোষপর্দার দুপাশে থাকলে তড়িৎ প্রবাহ আর হয় না । এই না হলে বিজ্ঞানী*২ !
পরে কেনেথ আর জর্জের যান্ত্রিক আয়োজনটির আরো পরিবর্তন করে নিখুঁত ভাবে তড়িৎ প্রবাহ মাপার কাজটি করলেন অ্যালেন হজকিন (Alan Hodgkin) এবং তার পিএইচডি ছাত্র অ্যান্ড্রু হাক্সলে (Andrew Huxley)। কিভাবে করলেন - ব্যাপারটা বাংলায় বোঝা যাক। প্রথমে দুটি তড়িৎদ্বার বানানো হলো, যার একটি দানবাকৃতি স্নায়ু কোষে ঢুকে যাবে অন্য টি বাইরের পরিবেশে থাকবে । প্রথমটিকে মাপক তড়িৎদ্বার (measuring electrode) , দ্বিতীয়টি নির্ণায়ক তড়িৎদ্বার (reference electrode)। চিত্র ১ এ যান্ত্রিক আয়োজনটি দেখানো হয়েছে।
চিত্র ১. আধান নিয়ন্ত্রণ বন্ধনী মাধ্যমে দানবাকৃতি স্নায়ু কোষে তড়িৎপ্রবাহ মাপার ব্যবস্থা । |
১) যদি দানবাকৃতি স্নায়ু কোষ থেকে কোনো তড়িৎ প্রবাহ হয় তবে তা মাপক তড়িৎদ্বার আর নির্ণায়ক তড়িৎদ্বারের মাধ্যমে জানা যাবে, তারপর তা সংকেত পরিবর্ধক এর মাধ্যমে বেশ কয়েক গুন্ বাড়াতে হবে, কারণ কোষের মধ্যে তড়িতের পরিমান খুব - খুব কম যা যন্ত্রে সুস্পষ্ট ধরা পড়া মুশকিল । ধরা যাক এই তড়িৎ প্রবাহ Vm এর সমতুল্য ।
অতএব, কোষের ভেতরের আর বাইরের আধান পার্থক্য = Vm যার জন্য তড়িৎ প্রবাহ হচ্ছে ।
২) এরপর Vm কে শুন্য করার জন্য বাইরে থেকে তড়িৎ পার্থক্য কত দরকার তা যন্ত্র অতি দ্রুত নির্ধারণ করে । ধরা যাক সেটি Vc । সংকেত সম্মন্বয়ীকারক পরিবর্ধক এই Vc এর সমানুপাতিক তড়িৎ প্রবাহ ঘটাবে ।
৩) তড়িৎ পরিমাণ নথিকারকের মাধ্যমে জানা গেল যে কত পরিমান তড়িৎ প্রবাহ হলো ।
৪) সেই পরিমান তড়িৎ কোষে পাঠানো হলো তড়িৎ সরবরাহকারী তড়িৎদ্বার মাধ্যমে, ফলে কোষের থেকে তড়িৎ প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে ।
তড়িৎ পরিমাণ নথিকারকের মাধ্যমে জানা গেল Vc এর পরিমান কত। যে Vc পরিমানে কোষের থেকে আর কোনো তড়িৎ প্রবাহই আর হয় না সেই Vc কে বলা হয় স্থিতাবস্থা আধান পার্থক্য ।
এই ক্ষণজন্মা তড়িৎপ্রবাহ আর এই যৎসামান্য আধানের পার্থক্যের সাধ্য কি তা পরে বলা যাবে ।
----------------------------------------------------------
*১ সে সময়কার বহু গুণী ব্যক্তি, যেমন দার্শনিক ও গণতজ্ঞ রেঁনে দেকার্তে (Rene Descartes :যার নামে কার্টেসিয়ান কোঅর্ডিনেটস) মনে করতেন যে আমাদের স্নায়বিক প্রবাহ মূলত আত্মার চলন গমনের দ্বারা প্রভাবিত । কেমব্রিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস গিলসন কাঁচের জারে হাতটাত ঢুকিয়ে মুঠো খুলে আর বন্ধ করে একটি পরীক্ষাও করেন, আর সিদ্ধান্তে আসেন যে আত্মার প্রবাহ, মুঠো খুলে আর বন্ধ করার ফলে যে পরিমান জল অপসারিত হয় তার সমানুপাতিক !
[সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এরা সকলেই পদার্থবিজ্ঞানী তাও যত উৎসাহ জীববিজ্ঞানে ]
*২ দুটো কথা আমার এখনো মনে আছে । এ উক্তি আমার স্কুলের শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইদের । "বিজ্ঞানীদের খুব বুদ্ধি " , আর "এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান"।
*পরিভাষা :
ঋণাত্মক তড়িৎ প্রতিক্রিয়া = Negative Feedback
আধান নিয়ন্ত্রণ বন্ধনী = Voltage Clamping
মাপক তড়িৎদ্বার = Measuring (অথবা Recording) Electrode
নির্ণায়ক তড়িৎদ্বারের = Reference Electrode
সংকেত পরিবর্ধক = Voltage Amplifier (এখানে)
সংকেত সম্মন্বয়ীকারক পরিবর্ধক = Voltage Feedback Amplifier
তড়িৎ পরিমাণ নথিকারকের = Measure Current
তড়িৎ সরবরাহকারী তড়িৎদ্বার = Current Supplying Electrode
স্থিতাবস্থা আধান পার্থক্য = Resting Potential
তথ্য সংগ্রহ : ইন্টারনেট