Wednesday, 15 July 2020

প্রোথিত দশা ৩

Nadar  চলেছেন সাখ্যাৎকার  নিতে । ১৮৮৬ সাল, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ছবিসহ সাখ্যাৎকার হবে এটা। Nadar এর মুকুটে তখন পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম Aerial ফটোগ্রাফারের শিরোপা *১। এবার জুড়বে প্রথম ছবিসহ সাখ্যাৎকার তোলার শিরোপা । যার সাখ্যাৎকার নিতে চলেছেন তার বয়স একশো পূর্ণ হবে এই আগস্টের শেষে - তিনি বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ রসায়নবিজ্ঞানী  Michel Eugene Chevreul । ফ্রেডরিক রাইনিৎজার কোলেস্টেরোলের "তরলাইত-স্ফটিক"দশার আবিষ্কর্তা (প্রোথিত দশা ১) আর কোলেস্টেরল এর নামকরণ যিনি করেন, তিনি Michel Eugene Chevreul ।

"কোলেস্টেরল" নামটা একটু স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তির কাছে বিভীষিকার মতন । উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগের সঙ্গে নামটা যেমন অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, উহান ভাইরাস বা Covid-19 ভাইরাসের সঙ্গেও তার একটা প্রছন্ন যোগাযোগ থাকতে পারে । কিভাবে ? উহান ভাইরাস আমাদের দেহকোষের প্রবেশের জন্য, আমাদের দেহের একটি প্রোটিনকে ব্যবহার করে । আমাদের দেহের ওই দায়ী প্রোটিনটি হলো "এনজিওটেনসিন - ২ (Angiotensin-II)" । আমরা বেশিরভাগ উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করি তাও এনজিওটেনসিন - ২ এর কাজ বন্ধ করে থাকে । দেখা গিয়েছে "স্ট্যাটিন" নামক যে ওষুধটি খেলে আমাদের দেহের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে, সেই "স্ট্যাটিন" ওষুধটি খাওয়া লোকেদের প্রতি উহান ভাইরাস কম আক্রমণাত্মক । যদিও এখনো পর্যন্ত কোলেস্টেরল আর উহান ভাইরাসের যোগাযোগটা পুরোপুরি প্রমাণিত নয় । তবে সাধারণ বুদ্ধি থেকে এটুকু বলা যায় যে যেহেতু কোলেস্টেরোলের উচ্চরক্তচাপ-হৃদরোগের সঙ্গে সম্পর্ক, আর উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করা হয় এনজিওটেনসিন - ২ এর মাধ্যমে তবে উহান ভাইরাস এর সঙ্গেও কোলেস্টেরোলের সম্পর্ক থাকাটা অস্বাভাবিক নয় । চিত্র ১ এ এনজিওটেনসিন - ২ আর তার সংলগ্ন আমাদের কোষপর্দার প্রোটিনটিকে দেখানো হয়েছে। আর লাল রঙের প্রোটিনটি ভাইরাসের একটা প্রোটিনের অংশ  ।
চিত্র ১. এনজিওটেনসিন-২ আর উহান ভাইরাসের অংশ : উহান ভাইরাসের প্রবেশের মাধ্যম হলো আমাদের দেহের "এনজিওটেনসিন -২" । এনজিওটেনসিন - ২ আবার কোষপর্দা সংলগ্ন প্রোটিনটির মাধ্যমে কাজ করে । আমাদের দেহের আর একটি সম্ভাব্য প্রোটিন (নীল) কেও দেখানো হয়েছে যা উহান ভাইরাস কে আটকে দিতে পারে। কিন্তু সাধারণ ভাবে আমাদের দেহে এই প্রোটিনগুলো থাকে না।

উহান ভাইরাসের প্রবেশ আমাদের মুখ্য আলোচ্য নয় ।  আমাদের প্রোথিত দশার নায়ক "কোলেস্টেরল" এ ফিরে  আসি ।

কোষপর্দার গঠনের ভিত্তিপ্রস্থর Singer আর Nicolson এর মতবাদ (প্রোথিত দশা ২) এতটাই  দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে কোষপর্দার গঠন সহজে বোঝাতে গেলে ওটাই পথ । এ বিষয়ে Nicolson এর একটি সাম্প্রতিক লেখাও আছে । কিন্তু উন্নিশশো আশির দশক থেকেই এই ধারণা তে পরিবর্তন হতে শুরু করে । তার কিছু আমরা আলোচনাও করেছি (প্রোথিত দশা  ২) ।

১৯৬৭ সাল, এই পরিবর্তনের সূচনা মূলত যার হাত ধরে তিনি তখন Rockefeller বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত  । একদা পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাওয়া ছাত্রের গবেষণার বিষয়ও একটা ভাইরাস, না উহান ভাইরাস নয়, আফ্রিকার উগান্ডায় প্রথম আবিষ্কার হওয়া Semliki Forest ভাইরাস । Singer আর Nicolson এর মতবাদ অনুযায়ী আমাদের কোষপর্দা একটা লিপিড সমুদ্র আর এই সুষম ভাবে বিন্যস্ত লিপিডের সমুদ্রে, থেকে থেকে গাছের গুঁড়ির মতো ভেসে চলেছে প্রোটিন । এই Semliki Forest ভাইরাসের প্রাণও লিপিড সমুদ্র দিয়ে ঢাকা, আর তাতে ভেসে চলেছে একটিই প্রোটিন । লিপিড সমুদ্র থেকে প্রোটিনকে আলাদা করতে হলে ব্যবহার করতে হয় detergent । এই detergent কতকটা আমাদের Surf Exel, Ariel, বা Tide এর detergent এর মতোই । ভদ্রলোক ততদিনে Rockefeller থেকে চলে এসেছেন Helsinki বিশ্ববিদ্যালয়ে । Semliki Forest ভাইরাসের ওই প্রোটিনটিকে আলাদা করার চেষ্টা করছিলেন । বাধা পেলেন, কেমন বাধা ? এ প্রোটিন সহজে আলাদা হতে চায় না লিপিড সমুদ্র থেকে ! আজব কান্ড !  Singer আর Nicolson এর মত মানতে হলে লিপিড সমুদ্রের যে অংশেই প্রোটিন ভেসে বেড়াক ওকে আলাদা হতেই হবে । কিন্তু Semliki Forest ভাইরাসের ওই প্রোটিনটি যেন আলাদা । এমন সময় একটা বিশাল সুযোগ এলো ।

বিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে আমেরিকা আর ইউরোপের মধ্যে জীববিজ্ঞান নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন লড়াই শুরু হয়ে গেছিলো *২। আমেরিকাকে মাৎ দিতে জার্মানির হাইডেলবার্গ শহরে প্রতিষ্টা হয় ইউরোপিয়ান মলিক্যুলার বায়োলজি ল্যাবরেটরি । আমরা অনেকেই একে EMBL নাম চিনি। EMBL এর  প্রথম অধিকর্তা হিসেবে যোগ দেন John Kendrew । যোগ দেন Helsinki বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকও ।Semliki Forest ভাইরাসের ওই প্রোটিনটি detergent কে ঠিক কাজ করতে দেয় না । গবেষক তাঁর গবেষণার মাধ্যম পাল্টালেন । কাজ শুরু করলেন এক ধরণের প্রাণীজ কোষ নিয়ে । জীববিজ্ঞানের ভাষাতে ওই কোষের নাম হলো MDCK কোষ । আমরা আগে দেখেছি লোহিত কোষের (Red Blood Cell ) কোষপর্দা নিয়ে কাজ করতে । আমরা দেখেছি লাইপোসোমের কৃত্রিম কোষপর্দার ওপরেও কাজ করতে। কিন্তু MDCK কোষ সেটা কি বস্তু? ১৯৫৮ সালে এই কোষ কে আলাদা করতে সমর্থ হন Stewart Madin আর Norman Darby জুনিয়র । ক্রোকার স্পানিয়াল জাতের কুকুরের বৃক্ক (Kidney) থেকে আলাদা করা কোষ । তবে সে যে সে কোষ নয় । এপিথেলিয়াল কোষ । এপিথেলিয়াল কোষ হলো প্রাণীর দেহের উপরিভাগের কোষ । বিশেষ কারণে এমন উপরিভাগের কোষ গুলিকে একটু বিশেষ আকৃতির হতে হয় (চিত্র ২)।
চিত্র ২. এপিথেলিয়াল কোষ: বাইরের দিকটি কে বলে
এপিক্যাল দিক, ভেতরের দিকটি বেসোল্যাটারাল দিক ।
কমলা তীরচিহ্ন একধরণের লিপিডের গতিপথ ইশারা
করছে আর খয়েরি আর এক ধরণের ।
MDCK কোষ কে ব্যবহার করার কারণ হলো Semliki Forest ভাইরাস বৃক্কের কোষ কে আক্রমণ করে আর MDCK বৃক্কের কোষ । কাজ শুরু করার অচিরেই বোঝা গেল - MDCK কোষের দুটো দিক আকৃতিগত ভাবে শুধু আলাদা তা নয়, দুধারের কোষপর্দার প্রোটিন আর লিপিডের পার্থক্যও স্পষ্ট । চিত্র ২ এ রঙিন তীর চিহ্নের মাধ্যমে এই বিভাজন দেখানো হয়েছে । আর আশ্চর্য্য এই যে , এপিক্যাল দিকের কোষপর্দা থেকে detergent দিয়ে প্রোটিন আলাদা করা যায় না । Semliki Forest ভাইরাসের লিপিড পর্দাও একই ধর্ম দেখায় ।

সব বিবেচনা করে গবেষক দেখালেন যে, এপিক্যাল দিকের কোষপর্দায় লিপিড অণুগুলি সুষমভাবে বিন্যস্ত থাকে না , বরং কিছু কিছু জায়গায় যেন লিপিড অণুগুলি গাঢ় ভাবে সন্নিবদ্ধ থাকে, আর ওই গাঢ় জায়গাগুলো অনমনীয় । যেন অশান্ত সমুদ্রে ভাসমান ভেলা। নামকরণ করা হয় লিপিড রাফ্ট  (lipid raft)। আর লিপিড রাফ্টের কালপ্রিট কে ? কোলেস্টেরল আর সঙ্গে দোসর স্ফিঙ্গলিপিড । লিপিড রাফ্ট detergent এ বশীভূত হয় না । তাই লিপিড রাফ্টএ থাকা প্রোটিনগুলো কে detergent আলাদা করতে পারে না । Kai Simons কে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল ব্যাপারটাকে সর্বজনবিদিত করতে । আশির দশকের মাঝামাঝি লিপিড রাফ্টের ধারণা দিলেও Kai এর মতামত Nature পত্রিকা ছাপতে রাজি হতে হতে ১৯৯৭ সাল হয়ে যায় !

John Beresford Leathes ও প্রায় একই জিনিস লক্ষ্য করেছিলেন (প্রোথিত দশা  ২), যে লিপিডের সঙ্গে থাকা কোলেস্টেরোল লিপিডের ধর্ম পাল্টে দেয়, লিপিড আরো গাঢ় সন্নিবদ্ধ হয়ে যায় ।লিপিডের সমুদ্রে লিপিডের চাঞ্চল্য বন্ধ করতে কোলেস্টেরোল অপরিহার্য ।

প্রাণিকোষে যে লিপিড প্রচুর পরিমানে আছে তা ফোসফাটিডিল কোলিন ।ফোসফাটিডিল কোলিনের একটি পোশাকি নাম আছে, "লেসিথিন"। এই লেসিথিন কোলেস্টেরলের সংস্পর্শে এলে এক্কেবারে সটান সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পরে । নড়াচড়া কমিয়ে দেয় । আমরা ফসফোলিপিডের লম্বা ঠ্যাঙের সঙ্গে পরিচিত (প্রোথিত দশা ১)। জলের সংস্পর্শে এলে এরা সার বেধে দাঁড়িয়ে পরে এও জানি (একটি প্রতীকী কোষ পর্দা) । ফসফোলিপিডের লম্বা ঠ্যাঙগুলো বেশিরভাগই  কার্বন -কার্বন সম্পৃক্ত বন্ধনী দিয়ে তৈরী (carbon - carbon single bond) যা কেবল হাইড্রোজেনের সঙ্গে যুক্ত । উচ্চ মাধ্যমিকের জৈব রসায়নের প্রথম দিকের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে যে কেবল হাইড্রোজেন-অলা কার্বন -কার্বন সম্পৃক্ত বন্ধনীতে বন্ধনীগুলি সবচেয়ে চঞ্চল । তাই লিপিডের সমুদ্রে ফসফোলিপিডের লম্বা ঠ্যাঙগুলো চঞ্চল থাকে । এই চঞ্চলতা কোষপর্দা স্থিত কিছু প্রোটিনের সহ্য হয় না তাই তাদের সুবিধার্থে কোলেস্টেরলের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পরে। কোলেস্টেরল, লিপিডের লম্বা -লম্বা ঠ্যাঙগুলোর মাঝে গ্যাঁট হয়ে বসে পরে ওদের নড়ন-চড়ন থামিয়ে দেয় । এর থেকেই লিপিড রাফ্টের জন্ম ।

Kai এর প্রায় একই সময়, ১৯৮৭ সালে,  আরেকটি  স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ*৩ ডেনমার্কের বিজ্ঞানী Oleg Mouritsen লিপিডের এই "নট নড়ন-চড়ন" দশার কথা বর্ণনা করেন  আর নাম দেন "শৃঙ্খলাবদ্ধ লিপিড" (lipid ordered state) । যেহেতু অসমপর্দার মধ্যে মধ্যে কোলেস্টেরল গেঁথে গেঁথে এই নতুন দশার উদ্ভব তাই "প্রোথিত দশা" । কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান কিন্তু তার পরিমান সীমিত হতে হবে । জীবকোষ গতিমান, আর তাই এই জীবকোষপর্দার চঞ্চলতাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়  ।

--- প্রাপ্তিস্বীকার:  পায়েল


[পরে সময় পেলে কোষপর্দার অনেক গপ্পো আরো বলা যাবে ]

----------------------------------------------------------------------------------------------
*১ ১৮৫৮ সালে প্রথম ফানুসে চড়ে প্যারিস মহানগরীর ছবি তোলেন তিনি। Nadar এর ছবির কিছু অংশ এতে পাওয়া যাবে https://www.youtube.com/watch?v=erT2W5sxaFY .

*২ আমরা আমেরিকা-রাশিয়া , আমেরিকা-চীন এর সম্ভাব্য ঠান্ডা লড়াইয়ের কথা খবরের কাগজের থেকে বেশি করে জানি, কিন্তু যে প্রতিযোগিতা বিজ্ঞান কে ঠেলে তুলেছে তার প্রায় সবটাই আমেরিকা-ইউরোপের ঠান্ডা লড়াইএর ফল বলা যায় । লক্ষণীয় যে সব ক্ষেত্রেই মূল দেশটি হলো আমেরিকা !

*৩ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ পাঁচটি ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যাণ্ড (হেলসিঙ্কি), নরওয়ে , আর আইস্ল্যাণ্ড