Friday, 28 September 2018

একটি প্রতীকী কোষ পর্দা


যে কোনো একটি কোষকে নিয়ে, তার কোষ পর্দার ওপর কাজ করা অত্যন্ত কঠিন কারণ, কোষের মধ্যে কোষ পর্দা ছাড়াও আলাদা আলাদা অংশ থাকে (যেমন, "মাইটোকন্ড্রিয়া", এন্ডোপ্লাজমিক  রেটিকুলাম", "গলগি বস্তু" ইত্যাদি)। এগুলো, একক ভাবে কোষ পর্দার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার পথে বাধার সৃষ্টি করে। তাই কোষ পর্দার ওপর কাজ করতে এমন একটি কোষের দরকার যে কোষে, কোষ পর্দা ছাড়া বাকি অংশগুলো কম আছে। বৈচিত্রের এই পৃথিবীতে এমন কোষ অমিল নয়।

রক্ত কণিকার জন্ম অস্থিমজ্জা থেকে, অবশ্য সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত যে রক্ত কণিকার জন্ম ফুঁসফুঁসেও হয়। সে যাক গে, লোহিত রক্ত কণিকার বাবা-মা রা অস্থিমজ্জাতেই থাকে। একটি পরিণত লোহিত কণিকা আমাদের জন্য অনেক ত্যাগস্বীকার করে। ওরা জন্মাবার সময় ওদের কোষের ভেতরে একটি অপরিহার্য অংশ "নিউক্লিয়াস" থাকে; কিন্তু যতই বড় হয় ততোই দায়িত্বজ্ঞান বাড়ে এবং আরো বেশি করে অক্সিজেন বহন করার জন্য ওরা ওদের  নিউক্লিয়াসটি পরিত্যাগ করে|  ক্রমে ক্রমে কোষের বাকি অংশগুলোও ("মাইটোকন্ড্রিয়া", এন্ডোপ্লাজমিক  রেটিকুলাম", "গলগি বস্তু") পরিত্যাগ করে । শেষমেশ লোহিত কোষে যে অংশটি থেকে যায় তা প্রধানতঃ তার কোষ পর্দা।  তাই একক ভাবে কোষ পর্দার ওপর কাজ করতে লোহিত কোষের জুড়ি মেলা ভার। এঅবস্থায় লোহিত কোষের পর্দার বাইরের অংশ নিয়ে পরীক্ষা করা যায়। আবার এই লোহিত কোষ কে তার কোষের থেকে কম ঘনত্বের তরলে ফেললে কোষটি তার কাঠামো হারায়। এই প্রক্রিয়া কে হিমোলাইসিস বলে। হিমোলাইসিসের ফলে যেটি পাওয়া যায় সেটিকে বিজ্ঞানীরা লোহিত কোষের ভূত, "Ghost" বলে থাকেন। হিমোলাইসিসের ফলে ওর ভেতরের পর্দার ওপরেও কাজ করা যায়।

কিন্তু রক্ত তো গাছে ফলে না। তাই বিজ্ঞানীরা লোহিত কোষের বিকল্প খুঁজতে লেগে গেলেন, পেলেনও। 

সেই ১৯৬৪ সাল - ঠিক যে বছর Humberto তাঁর আর্টিকেল টি প্রকাশ করেন। সেই বছরই Alec Banghamও ফসফোলিপিডের ওপর একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন জার্নাল অফ মলিক্যুলার বায়োলজিতে। ফসফোলিপিড কি ? আমরা আপাততঃ জেনে রাখি যে ফসফোলিপিড হলো সেই সব lipid যাদের মধ্যে ফসফেট থাকে। আমি গত পর্বে যে চারটে lipid এর কথা লিখেছিলাম তার মধ্যে তিনটির নামের মধ্যে তো "ফসফো" শব্দটি আছেই, এছাড়া স্ফিঙ্গলিপিডের মধ্যেও "ফসফো" অর্থাৎ "ফসফেট" থাকতে পারে। ফসফোলিপিডের মাথা অংশটি জলকে ভালোবাসে, আর পা অংশটি জল থেকে দূরেই থাকে।  

এটা ১৯৫৮-৫৯ এর কথা। Alec Bangham কেম্ব্রিজ থেকে কিছুটা দূরে বব্রাহাম নামের একটা গ্রামে Animal Physiology ইনস্টিটিউটে গবেষণার কাজ করছিলেন। তাঁর গবেষণার পেছনে ছিল ফসফোলিপিড কে জলে ফেললে কিরকম হয় তা জানার ইচ্ছে। Lipid কে জলে মেশালে মিশ্রণটা দুগ্ধবৎ ঘোলা হয়ে যায়। তাই তিনি তাকে Emulsion* আখ্যা দেন। এর পর ১৯৬১ তে বব্রাহামের Institute এ একটা ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ কেনা হয়। Alec খুব উচ্ছসিত। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে ওই দুগ্ধবৎ মিশ্রণটিকে কেমন দেখতে লাগে তা জানার জন্য। Alec এর এক সহকর্মী R. W. Horne তাঁকে এব্যাপারে সাহায্য করেন। কিন্তু দেখার পর বোঝা গেল জিনিসটা Emulsion এর থেকে বেশ আলাদা। 

Alec এর বর্ণনা অনুসারে ফসফোলিপিডগুলো জলে সার বেঁধে বিভিন্ন আকৃতির বদ্ধ খুপরি তৈরী করে। বদ্ধ খুপড়িগুলোর প্রাচীর একস্তরীয় (ইউনি-ল্যামেলার; Uni-lamellar) বা বহুস্তরীয় (মাল্টি-ল্যামেলার; multi-lamellar) হতে পারে। এরকম প্রতিটি স্তরের দুটি দিক থাকে (চিত্র ১.)। একটি দিকের ফসফোলিপিডগুলো অন্য দিকের  ফসফোলিপিডগুলোর পা ধরাধরি করে মাথাগুলো জলীয় মাধ্যমের দিকে উঁচিয়ে রাখে। এভাবে ছোট ছোট জলীয়-মাধ্যম ওয়ালা খুপরি তৈরী হয়, যেখান ভেতরের জলীয় মাধ্যম বাইরের জলীয় মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন ফসফোলিপিডের দ্বারা। ঠিক যেন একটা একটা কোষ পর্দার মতন। Alec ওই খুপড়িগুলোর নাম দেন লাইপোসোম (liposome; গ্রিক lipo = ফ্যাট, soma = শরীর) আর সতীর্থরা মজা করে বলতো "ব্যানঘাসোম" (Banghasomes) 
ক                                    খ    
চিত্র ১.  লাইপোসোম কে একটি ফাঁপা গোলাকৃতি বলয় (ত্রিমাত্রিক) হিসেবে কল্পনা করা চলে যার ভেতরের আর বাইরের দিকে থাকে জলীয় মাধ্যম। চিত্রে লাইপোসোমের দ্বিমাত্রিক গঠন দেখানো হয়েছে। ক) একটি বহুস্তরীয় লাইপোসোম, খ) একটি একস্তরীয় লাইপোসোম, লাইপোসোমের প্রাচীর দুদিকের ফসফোলিপিডগুলো সার বেঁধে - পরস্পরের পা (কালো) ধরে জলের দিকে মাথা (খয়েরি রং) উঁচিয়ে বিরাজ করে (একটি অংশ কে বড় করে দেখানো হয়েছে)।    

লাইপোসোমের আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি বড় অগ্রগতি। লাইপোসোমের মাধ্যমে ওষুধকে শরীরের কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছে দেওয়া যায়। যেমন, এন্থ্রাসাইক্লিন (Anthracycline) ড্রাগগুলি ক্যান্সার কোষের বিভাজন বন্ধ করে। কিন্তু সেই ড্রাগ অন্য কোষে ঢুকলে সে কোষের ক্ষতি। তাই এমন ভাবে কিছু লাইপোসোম বানানো হয় যা কেবল মাত্র ক্যান্সার কোষের সঙ্গেই মিলতে পারে। এভাবে লাইপোসোমের সাহায্যে কেবল ক্যান্সার কোষ কে ধরে ধরে মেরে ফেলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা যে লাইপোসোমকে একটি কৃত্রিম কোষ পর্দা হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে যেখানে শুধু lipid দিয়ে তৈরী কোষ পর্দাই থাকে কিন্তু কোষের বাকি অংশ যেমন প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি থাকে না।

লাইপোসোম আবিষ্কারের খ্যাতি কিন্তু Alec Bangham কে বিচলিত করতে পারে নি। তিনি তাঁর ওই গ্রাম্য ইন্সটিটিউটটির ছোট ল্যাবরেটরিটি ছেড়ে কোথাও যান নি।  

------------------------------------------------------------------------------------------------

* Emulsion হলো গিয়ে দুটো ঠ্যাঁটা অথচ অ-মিশুকে তরলের মিশ্রণ। ঠ্যাঁটা, কারণ একটা আরেকটার থেকে কখনই আলাদা হয় না আবার মিশেও যায় না।


চলবে ...

অনুপ্রেরণা : An Introduction to Biological Membranes: Composition, Structure and Function by William Stillwell

তথ্য সংগ্রহ : ইন্টারনেট

প্রাপ্তিস্বীকার : পায়েল



Saturday, 1 September 2018

এক অসম পর্দার কথা



৯৭০ সালে Mark Bretscher তাঁর কেম্ব্রিজ এর ল্যাব এ লোহিত রক্তকণিকা পরীক্ষা করছিলেন। তিনি এক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে দেখালেন যে ওই রক্তকণিকার কোষ পর্দার দুটো দিক দু' রকম অনু দিয়ে তৈরী।

এখানে বলে রাখি, যে কোনো কোষ পর্দার দুটো দিক থাকে - একটা বাইরের দিক আর একটা ভেতরের দিক । আর এই কোষ পর্দার গঠন এর জন্য অত্যাবশ্যকীয় অনু হলো lipid। বাংলা তে আমরা যাকে "স্নেহ পদার্থ *" বলে থাকি। আমাদের  দেহে যে প্রায় "তিন কোটি বাহাত্তর লক্ষ কোটি " কোষ আছে তার প্রত্যেকটার পর্দার মূল গঠন ওই "স্নেহ পদার্থ " দিয়ে। তা, ওই স্নেহ পদার্থের অনেক ভাগ আছে। সব তো এখানে বলা যাবে না, কেবল চারটের নাম করবো যেগুলো একটু বেশিই থাকে। এমন চারটে হলো: ফসফাটিডিল কোলিন, ফসফাটিডিল ইথানোলামিন, ফসফাটিডিল ইনসিটোল, আর স্ফিঙ্গলিপিড।

Mark Bretscher এর আগে সাধারণ ধারণা ছিল না যে কোষ পর্দার দুটো দিকের অনুর ধরণ দু রকম।আমার এই লেখার বিষয় আমাদের কোষ পর্দার দু দিকের অসাম্ম্য এবং তার সঙ্গে জড়িত আশ্চর্য কিছু কথা।

Mark Bretscher দেখালেন যে রক্তকণিকা র বাইরের দিকে ফসফটিডিল কোলিন আর স্ফিঙ্গলিপিড বেশি পরিমানে থাকে আর ভেতরের দিকে ফসফটিডিল ইথানোলামিন আর  ফসফটিডিল ইনসিটোল বেশি থাকে। কিন্তু এই যে অপ্রতিসম গঠন তার কি কোনো কাজ আছে? সে উত্তর বলতে গেলে আরো কিছু জানানো দরকার।

আমাদের দেহে কোষ পর্দা সবসময় পরিবর্তনশীল - খালি তৈরী হচ্ছে আর ক্ষয় হচ্ছে। আর এই তৈরী ও ক্ষয় কোষ পর্দার যে অংশ থেকে হয় সেই জায়গায় কোষ পর্দার বক্রতা বেড়ে যায় এবং তার জন্য কোষ পর্দার দু ধারের  অপ্রতিসম গঠন দায়ী।

আর দ্বিতীয় কাজটি জানার জন্য আমাদের ১৯৭০ থেকে আরো ছয় বছর পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৬৪ সালে ।সে বছর একজন ভেনিজুয়েলান বিজ্ঞানী তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে জার্নাল অফ সেল বায়োলজি তে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন। Humberto Fernandez-Moran ১৯৪৪ সালে, যেসময় জার্মানি যুদ্ধবিদ্ধস্ত, সেসময় ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখ (জার্মানি) থেকে PhD ডিগ্র্রী লাভ করেন। উনিই প্রথম diamond-knife এর ব্যবহার করেন, যা ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ এ দেখার জন্য, শরীরের কোষ কাটার জন্য ব্যবহার করা হয় । উনি NASA র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন চাঁদের থেকে আনা পাথর বিশ্লেষণ করার জন্য ।ওনার কাজের জন্য ওনাকে Nobel Prize এর জন্য মনোনীত করা হয় কিন্তু উনি তা অস্বীকার করেন কারণ শর্ত ছিল যে তাকে U.S.A র নাগরিকত্ব নিতে হবে ।এহেন একজন নীতিবাদী বিজ্ঞানী জার্নাল অফ সেল বায়োলজি তে যে আর্টিকেল টি লেখেন সেখানে উনি গরুর হার্ট এর পেশীর কোষের একটা ছোট্ট অংশ বিশ্লেষণ করছিলেন । ওই ছোট্ট অংশটির নাম মাইটোকন্ড্রিয়া। মাইটোকন্ড্রিয়া কোষের শক্তি সরবরাহ করে কোষ কে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে ।Humberto লক্ষ্য করলেন যে মাইটোকন্ড্রিয়ার পর্দার গায়ে ভেতরের দিকে মুখ করে সার বেঁধে এক ধরণের মাশরুম এর মতন অনু সাজানো আছে ।উনি এটাকে "ম্যাক্রোমলিক্যুলার রিপিটিং ইউনিট" আখ্যা দেন। এই ভাবে সাজানো অণুগুলো কে প্রোটিন বলে । Humberto যে প্রোটিন টি দেখেছিলেন সেটা কে আমরা "এটিপি সিন্থেজ" বলি। নিচের ছবিতে (ছবি. ১) ওটাকে আলট্রা-হাই রিসোলিউশন (ক্রায়ো ইলেক্ট্রন) মাইক্রোস্কোপ এ দেখতে যেমন লাগে তা দেখানো হয়েছে ।

ছবি. ১ : এটিপি সিন্থেজ 
এটিপি সিন্থেজ, অক্সিজেন ব্যবহার করে আমাদের দেহের শক্তি উৎপন্ন করে । এটিপি সিন্থেজ মাইটোকন্ড্রিয়ার পর্দার গায়ে অপ্রতিসম ভাবে রয়েছে - ওর বড় অংশটি ভেতরের দিকে আর ছোট অংশটি বাইরের দিকে মুখ করে আছে, আর নিচের কমলা রঙের সিলিন্ডার এর মতন অংশটি কোষ পর্দায় বসানো থাকে । প্রোটিনের এরকম অপ্রতিসম থাকার কারণটাও বোধ হয় কোষ পর্দার দু ধারের  অপ্রতিসম গঠনের জন্য ।

গরম আর ঠান্ডা গা-ঘেসিয়ে রাখলে তাপমাত্রা গরম থেকে ঠান্ডার দিকে ছড়িয়ে পরে, পজিটিভ আর নেগেটিভ কানেক্ট করলে বিদ্যুৎ পজিটিভ থেকে নেগেটিভ এর দিকে যায়*১ । বেশি থেকে কমের দিকে ছড়িয়ে দেওয়াটা প্রকৃতির ধর্ম - সেটা একটা সুস্থির অবস্থা তৈরী করার পক্ষে। আর এটাই তাপগতিবিদ্যা  (Thermodynamics) এর দ্বিতীয় সূত্র এর বিষয়বস্তু ।প্রাণ এর স্পন্দন যে তাপগতিবিদ্যা  (Thermodynamics) এর দ্বিতীয় সূত্র মেনে চলে তা বহুদিন আগেই বিখ্যাত কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী Erwin Schrödinger তাঁর "What is life" বইতে লিখে গেছেন।

কোষ পর্দার  অপ্রতিসম হওয়ার ধারণাও যেন এর সঙ্গে মেলে। একদিকে একটা জিনিস বেশি থাকলে তবেই তা কম এর দিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর কোষ পর্দা অপ্রতিসম রেখে, তার মধ্যে স্তিথ প্রোটিনকেও অপ্রতিসম ভাবে রাখলে  প্রাণ তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে ।

                                                                                                                              চলবে ...

অনুপ্রেরণা : An Introduction to Biological Membranes: Composition, Structure and Function by William Stillwell

তথ্য সংগ্রহ : ইন্টারনেট

প্রাপ্তিস্বীকার : পায়েল
---------------------
* "স্নেহ পদার্থ (বস্তু)" র ইংরেজি সঠিক সমার্থক হবে "Fat Body"; সেক্ষেত্রে Lipid কে লিপিড বলা যেতে পারে ।
*১ আসলে ইলেক্ট্রন (নেগেটিভ চার্জ) ধেয়ে যাই পজেটিভের দিকে, প্রথা অনুযায়ী উল্টো দিকের ফ্লো টাকে বিদ্যুৎ প্রবাহ ধরা হয় ।