যে কোনো একটি কোষকে নিয়ে, তার কোষ পর্দার ওপর কাজ করা অত্যন্ত কঠিন কারণ, কোষের মধ্যে কোষ পর্দা ছাড়াও আলাদা আলাদা অংশ থাকে (যেমন, "মাইটোকন্ড্রিয়া", এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম", "গলগি বস্তু" ইত্যাদি)। এগুলো, একক ভাবে কোষ পর্দার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার পথে বাধার সৃষ্টি করে। তাই কোষ পর্দার ওপর কাজ করতে এমন একটি কোষের দরকার যে কোষে, কোষ পর্দা ছাড়া বাকি অংশগুলো কম আছে। বৈচিত্রের এই পৃথিবীতে এমন কোষ অমিল নয়।
রক্ত কণিকার জন্ম অস্থিমজ্জা থেকে, অবশ্য সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত যে রক্ত কণিকার জন্ম ফুঁসফুঁসেও হয়। সে যাক গে, লোহিত রক্ত কণিকার বাবা-মা রা অস্থিমজ্জাতেই থাকে। একটি পরিণত লোহিত কণিকা আমাদের জন্য অনেক ত্যাগস্বীকার করে। ওরা জন্মাবার সময় ওদের কোষের ভেতরে একটি অপরিহার্য অংশ "নিউক্লিয়াস" থাকে; কিন্তু যতই বড় হয় ততোই দায়িত্বজ্ঞান বাড়ে এবং আরো বেশি করে অক্সিজেন বহন করার জন্য ওরা ওদের নিউক্লিয়াসটি পরিত্যাগ করে| ক্রমে ক্রমে কোষের বাকি অংশগুলোও ("মাইটোকন্ড্রিয়া", এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম", "গলগি বস্তু") পরিত্যাগ করে । শেষমেশ লোহিত কোষে যে অংশটি থেকে যায় তা প্রধানতঃ তার কোষ পর্দা। তাই একক ভাবে কোষ পর্দার ওপর কাজ করতে লোহিত কোষের জুড়ি মেলা ভার। এঅবস্থায় লোহিত কোষের পর্দার বাইরের অংশ নিয়ে পরীক্ষা করা যায়। আবার এই লোহিত কোষ কে তার কোষের থেকে কম ঘনত্বের তরলে ফেললে কোষটি তার কাঠামো হারায়। এই প্রক্রিয়া কে হিমোলাইসিস বলে। হিমোলাইসিসের ফলে যেটি পাওয়া যায় সেটিকে বিজ্ঞানীরা লোহিত কোষের ভূত, "Ghost" বলে থাকেন। হিমোলাইসিসের ফলে ওর ভেতরের পর্দার ওপরেও কাজ করা যায়।
কিন্তু রক্ত তো গাছে ফলে না। তাই বিজ্ঞানীরা লোহিত কোষের বিকল্প খুঁজতে লেগে গেলেন, পেলেনও।
এটা ১৯৫৮-৫৯ এর কথা। Alec Bangham কেম্ব্রিজ থেকে কিছুটা দূরে বব্রাহাম নামের একটা গ্রামে Animal Physiology ইনস্টিটিউটে গবেষণার কাজ করছিলেন। তাঁর গবেষণার পেছনে ছিল ফসফোলিপিড কে জলে ফেললে কিরকম হয় তা জানার ইচ্ছে। Lipid কে জলে মেশালে মিশ্রণটা দুগ্ধবৎ ঘোলা হয়ে যায়। তাই তিনি তাকে Emulsion* আখ্যা দেন। এর পর ১৯৬১ তে বব্রাহামের Institute এ একটা ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ কেনা হয়। Alec খুব উচ্ছসিত। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে ওই দুগ্ধবৎ মিশ্রণটিকে কেমন দেখতে লাগে তা জানার জন্য। Alec এর এক সহকর্মী R. W. Horne তাঁকে এব্যাপারে সাহায্য করেন। কিন্তু দেখার পর বোঝা গেল জিনিসটা Emulsion এর থেকে বেশ আলাদা।
Alec এর বর্ণনা অনুসারে ফসফোলিপিডগুলো জলে সার বেঁধে বিভিন্ন আকৃতির বদ্ধ খুপরি তৈরী করে। বদ্ধ খুপড়িগুলোর প্রাচীর একস্তরীয় (ইউনি-ল্যামেলার; Uni-lamellar) বা বহুস্তরীয় (মাল্টি-ল্যামেলার; multi-lamellar) হতে পারে। এরকম প্রতিটি স্তরের দুটি দিক থাকে (চিত্র ১.)। একটি দিকের ফসফোলিপিডগুলো অন্য দিকের ফসফোলিপিডগুলোর পা ধরাধরি করে মাথাগুলো জলীয় মাধ্যমের দিকে উঁচিয়ে রাখে। এভাবে ছোট ছোট জলীয়-মাধ্যম ওয়ালা খুপরি তৈরী হয়, যেখান ভেতরের জলীয় মাধ্যম বাইরের জলীয় মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন ফসফোলিপিডের দ্বারা। ঠিক যেন একটা একটা কোষ পর্দার মতন। Alec ওই খুপড়িগুলোর নাম দেন লাইপোসোম (liposome; গ্রিক lipo = ফ্যাট, soma = শরীর) আর সতীর্থরা মজা করে বলতো "ব্যানঘাসোম" (Banghasomes)
ক খ |
লাইপোসোমের আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি বড় অগ্রগতি। লাইপোসোমের মাধ্যমে ওষুধকে শরীরের কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছে দেওয়া যায়। যেমন, এন্থ্রাসাইক্লিন (Anthracycline) ড্রাগগুলি ক্যান্সার কোষের বিভাজন বন্ধ করে। কিন্তু সেই ড্রাগ অন্য কোষে ঢুকলে সে কোষের ক্ষতি। তাই এমন ভাবে কিছু লাইপোসোম বানানো হয় যা কেবল মাত্র ক্যান্সার কোষের সঙ্গেই মিলতে পারে। এভাবে লাইপোসোমের সাহায্যে কেবল ক্যান্সার কোষ কে ধরে ধরে মেরে ফেলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা যে লাইপোসোমকে একটি কৃত্রিম কোষ পর্দা হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে যেখানে শুধু lipid দিয়ে তৈরী কোষ পর্দাই থাকে কিন্তু কোষের বাকি অংশ যেমন প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি থাকে না।
লাইপোসোম আবিষ্কারের খ্যাতি কিন্তু Alec Bangham কে বিচলিত করতে পারে নি। তিনি তাঁর ওই গ্রাম্য ইন্সটিটিউটটির ছোট ল্যাবরেটরিটি ছেড়ে কোথাও যান নি।
লাইপোসোম আবিষ্কারের খ্যাতি কিন্তু Alec Bangham কে বিচলিত করতে পারে নি। তিনি তাঁর ওই গ্রাম্য ইন্সটিটিউটটির ছোট ল্যাবরেটরিটি ছেড়ে কোথাও যান নি।
------------------------------------------------------------------------------------------------
* Emulsion হলো গিয়ে দুটো ঠ্যাঁটা অথচ অ-মিশুকে তরলের মিশ্রণ। ঠ্যাঁটা, কারণ একটা আরেকটার থেকে কখনই আলাদা হয় না আবার মিশেও যায় না।
চলবে ...
অনুপ্রেরণা : An Introduction to Biological Membranes: Composition, Structure and Function by William Stillwell
তথ্য সংগ্রহ : ইন্টারনেট
প্রাপ্তিস্বীকার : পায়েল